সকালে ঘুম থেকে উঠে হোক বা দিনের শেষে বিকেলে হালকা নাস্তার সময়ে নিজেকে রিফ্রেশ করতে এক কাপ কফির বিকল্প কেউ কেউ ভাবতেই পারেন না। তবে শুধু ঘুম তাড়াতেই নয় বরং আরো নানান কারণে দরকার আছে কফির। জেনে নিন কফির কিছু গুণাগুণের কথা। তাহলে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এক কাপ কফি রাখতে খুব একটা ভুল হবে না। আর তাতে ফলাফলটাও কিন্তু খুব কম পাবেন না।
নিজেকে স্মার্ট করে তুলতে চান? তাহলে নিয়মিত কফি খান। কফিতে থাকা সবচেয়ে সক্রিয় উপাদানটির নাম ক্যাফেইন। কফি আপনার উদ্দীপনাকে খানিকটা বাধাগ্রস্ত করবে। তার মানে আপনি যদি একটু কোলাহলযুক্ত এবং বিশৃঙ্খল পরিবেশে কাজ করেন তাহলে কফি আপনাকে এই পরিস্থিতিতেই অমনোযোগ কাটিয়ে কাজে মনোযোগ দিতে সাহায্য করবে। সুতরাং পছন্দের পরিবেশ না পেলেও স্মার্টভাবেই কাজ শেষ করতে পারবেন আপনি।
পুষ্টিগুণ আর অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর এই পানীয়টি। কফিতে ভিটামিন বি৫, ভিটামিন বি২, থায়ামাইন বি১, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম রয়েছে। শুধু তাই নয়, কফিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আপনাকে রাখবে আরো বেশি সতেজ। আসুন জেনে নেওয়া যাক, কফি আবিষ্কারের ইতিহাস।
মানসিক চাপে বিপর্যস্ত আপনি? কি করবেন না করবেন বুঝে উঠতেই পারছেন না। তাহলে এক কাপ কফি খান। আপনার মানসিক ও শারিরীক চাপ মোকাবেলা করতে খানিকটা হলেও সহায়তা করবে কফি। ফলে চাপের কারণে যেসব রোগ দানা বাঁধে শরীরে সেসবও প্রতিরোধে সাহায্য করে কফি।
স্কিনক্যান্সারের প্রতিরোধক হিসেবেও বেশ কার্যকর কফি। ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউটের একটি গবেষণাপত্রে সম্প্রতি জানিয়েছে প্রতিদিন কফি পান করলে সেটা শরীরে ম্যালিগন্যান্ট মেলানোমা তৈরিতে বাধা দেয়। ফলে ত্বক রক্ষা পায় ক্যান্সারের হাত থেকে।
সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে কফি শুষ্ক চোখের সমস্যা সমাধানেও বেশ কার্যকর। ক্যাফেইন চোখের অশ্রুগ্রন্থিকে উদ্দীপিত করে সেই সঙ্গে সেটা সালিভা এবং পাচকরস তৈরি বাড়ায়।
কফি আবিষ্কারের ইতিহাস
ইন্টারন্যাশনাল কফি অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে সারা বিশ্বে ৬০ কেজি ওজনের কফির ব্যাগ বিক্রি হয় ৯ কোটি। আর ২০১৮ সালে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৬ কোটিতে। অনেক সচেতন কফিপ্রেমীও হয়তো জানেন না কফি আবিষ্কারের ইতিহাস।
কফির আবিষ্কার হয় নবম শতকে। খালেদি নামের মুসলিম এক মেষপালকের হাত ধরে। আরব- ইথিওপিয়ান এই রাখালের মেষগুলো ক্লান্ত হয়ে যেত। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল, মেষ-ছাগলগুলোর ক্লান্তিভাব দূর হয়ে গেছে। উদ্যমতা ও চঞ্চলতায় ভরে ওঠেছে শরীর ও মন। খালেদি এর কারণ অনুসন্ধান করতে শুরু করলেন। অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে লক্ষ্য করলেন, চেরি ফলের মতো খাচ্ছে ছাগলগুলো। ধর্মপ্রাণ ও তাপস-প্রকৃতির খালেদি গাছ থেকে কয়েকটি ফল নিয়ে নিলেন। এরপর দ্রুত হাজির হলেন স্থানীয় মসজিদের ইমামের কাছে।
ফলগুলো কাঁচা খেতে পারা সম্ভব হবে না ভেবে, ইমাম পাশে রাখা জ্বলন্ত আগুণে ফলগুলো ফেলে দেখলেন। প্রথমে ফলগুলোকে ‘শয়তানের প্রলোভন’ মনে হয়েছিল তার। কিন্তু কিছুক্ষণের ভেতর তার ধারণা পরিবর্তন হয়। আসতে থাকে বিমল সুঘ্রাণ। মুগ্ধ হতে থাকে হৃদয়-প্রাণ।
ইমামের শিষ্যরা ফলগুলো সিদ্ধ করে খেতে চাইলেন। তাই তারা সেই বীজগুলো একটি কড়াইতে রাখলেন এবং গরম পানি দিয়ে সিদ্ধ করলেন। এভাবেই পৃথিবীর প্রথম পানীয়-কফি তৈরি হয়।
ইমাম ও তার শিষ্যরা এই আবিষ্কারে খুব খুশি ও আনন্দিত হন। পানীয়টির প্রভাবে তারা দীর্ঘ রাত জেগে অধ্যাবসায় চালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। ইবাদত-বন্দেগি ও প্রার্থনার জন্য অত্যন্ত কার্যকরী উপাদানের ব্যবস্থা হয় তাদের। ক্রমে এই পানীয়ের কথা বিভিন্ন দিকে ছড়াতে শুরু করে। প্রাচীন ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে এভাবেই উল্লেখ রয়েছে।
কফি খাওয়ার উপকারিতা
অনেকে কফি পছন্দ করেন। কারও কারও আবার ধারণা কফি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এই ধারণাটি ভূল। বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনে অন্তত দু বার চিনি ছাড়া কফি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। সকালে ব্রেকফাস্ট এর পরে এক কাপ এবং সন্ধ্যা বেলায় এক কাপ কফি খাওয়া যেতে পারে। এক কাপ কফিতে ৬০% পুষ্টি, ২০% ভিটামিন এবং ১০% খনিজ ও ক্যালরি আছে। যা হার্ট সহ দেহের অন্যান্য অংশের উপকার করে থাকে। তবে তা অবশ্যই চিনি ছাড়া হতে হবে।
চলুন জেনে নেই কফির চমৎকার ৭ টি স্বাস্থ্যগুনঃ
স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিঃ ব্ল্যাক কফি মস্তিষ্ককে সচল রাখতে সাহায্য করে। যার ফলে মনে রাখার ক্ষমতা অনেকখানি বেড়ে যায়। এছাড়া এটি নার্ভকেও সচল রাখে।
ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি হ্রাস করেঃ কফির উপাদান সমূহ সুগার কমিয়ে দেয় এবং মেটাবলিজম বৃদ্ধি করে থাকে। যা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস করে। নিয়মিত কফি পানে ৭% ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে থাকে।
পেট পরিষ্কার করতেঃ কফি খেলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। চিনি ছাড়া কফি খেলে শরীরের ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ, ব্যাকটেরিয়া প্রস্রাবের সাথে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। যা পেট পরিষ্কার করে থাকে৷
ওজন হ্রাস করতেঃ কফি ওজন হ্রাস করতে সাহায্য করে। এটি মেটাবলিজম ৫০% বাড়িয়ে দেয় এবং এর সাথে পেটে জমে থাকা চর্বি গলাতে সাহায্য করে।
ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করেঃ এক সমিক্ষায় দেখা গেছে ব্ল্যাক কফি ২০% পুরুষের ক্যান্সার এবং ২৫% মেয়েদের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে থাকে। যারা প্রতিদিন ২ কাপ চিনি ছাড়া কফি পান করে তাদের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।
হার্ট সুস্থ রাখেঃ কফি দেহের ইনফ্লামেশন কমিয়ে হার্টের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করে থাকে। চিনি ছাড়া কফি হার্ট সুস্থ রাখে।
হাসিখুশি রাখেঃ এক কাপ কফি সাথে সাথে আপনার মুড ভালো করে দেয়। ক্যাফিন নার্ভ সিস্টেমকে প্রভাবিত করে আপনার মনকে খুশি করে দেয়।
কফি খেলে কি ওজন কমে?
বাড়তি মেদ ঝরিয়ে ফেলার জন্য নিত্যনতুন ডায়েট মেনে চলেন অনেকেই। সবার যে সব ধরনের ডায়েট সহ্য হয় এমনটাও নয়। আবার এক এক ডায়েটের সঙ্গে মেনে চলতে হয় এক এক রকম লাইফ স্টাইল। চা কফির নেশায় মেটকবলিক রেট কমে ওজন বাড়ে বলেই জানতেন তো? এর সঙ্গে দুধ চিনি যোগ হলে তো মেদের ঘরে ষোলো আনাই যোগ হল। তবে এবার মেদ কমানোর দাওয়াই হিসেবে কফিকে চিহ্নিত করেছেন ডায়েটেশিয়ানরা। তবে এই কফি অবশ্যই হতে হবে দুধ চিনি ছাড়া। আমরা যেটাকে বলি ব্ল্যাক কফি। কফির সঙ্গে কিছু আনুসংগিক খাবারের সৌজন্যেই এবার ঝরবে মেদ।
কফি ডায়েট
এই ডায়েট মানতে গেলে সারাদিন কয়েক কাপ কফি খেতে হবে আপনাকে। কফি বিপাকের হার বাড়িয়ে ক্যালরি বার্ন করতে সাহায্য করে। বেশি কফি খেলে ক্ষধাও কমে যায়।
মনে রাখতে হবে এই ডায়েটে দিনে অন্তত তিন কাপ কফি খেতে হবে৷ অবশ্যই চিনি দুধ ক্রিম ছাড়া। এই ডায়েট করলে সঙ্গে লো ক্যালরি যুক্ত এবং হাই ফাইবার খাবার খেতে হবে। যেমন, শাক সবজি, ফল, শস্য জাতীয় খাবার।
কফি ডায়েটের উপকারীতা
কফি ডায়েটে দুটো বড় লাভ হয়। প্রথমত এতে ক্ষুধা কমে। দ্বিতীয়ত এটি দেহে মেটাবলিজম বা বিপাকের হার বাড়ায়। আর ক্ষুধা কমে গেলে শরীরের ক্যালরি গ্রহণ ক্ষমতা কমে যায়। খাবার খাওয়ার আগে এক কাপ কফি খেয়ে নিলে ক্ষুধা কমে যায় এবং সেক্ষেত্রে বেশি খাওয়া হয় না।
সম্প্রতি ৬০০ জন কে নিয়ে এক সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে ক্যাফেন নিলে দেহের ওজন কমে। কফির পাশাপাশি খান ১৫০০ ক্যালরি খাবার। সাধারনত ১৫০০ ক্যালরি তে ক্ষুধা পাবার কথা নয়।তবুও ক্ষুধা নিয়ে ভাবনায় থাকলে খাবার আগে এক কাপ ব্ল্যাক কফি খেয়ে নিন।এতে ক্ষুধা কম পাবে। তারপর খাবেন শাক সবজি, ফল। এই সবে প্রচুর ফাইবার থাকে বলে অল্প খেলেই পেট ভড়ে যায় ও বেশিক্ষণ ভরা থাকে। তার উপরে ক্যালরি কম পুষ্টি বেশি ফলে হু হু করে ওজন কমিয়ে দেবে৷
তবে দীর্ঘদিন ধরে এই ডায়েট মেনে চলা শরীরের পক্ষে একটু ক্ষতিকারক। তাই কফি খান কিন্তু মাত্রা ছাড়িয়ে নয় এবং মেনে চলুন ডায়েটের অন্য নিয়ম গুলো।
কফি খাওয়ার অপকারিতা
পরিমিত পরিমাণে চা পান করার কিছু উপকারিতা রয়েছে। তবে কফি পান করার ক্ষেত্রে পরিমিত পরিমাণে পান করলেও এর কিছু ক্ষতিকর দিক রয়েছে। সে ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কফি পান এর ফলে আপনার স্বাস্থ্যের কতটা ক্ষতি হতে পারে বুঝতেই পারছেন।
হৃদপিন্ডের জন্য ক্ষতিকারকঃ কফিতে থাকা ক্যাফেইন হৃদপিন্ডের রক্ত সরবরাহকারী ধমনীতে রক্ত চলাচলের গতি কমিয়ে দেয়। এছাড়াও কফিতে থাকা ক্যাফেইন হৃদস্পন্দন এবং উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা সৃষ্টি করার জন্য দায়ী। সত্যিকার অর্থে কফিতে থাকা উপাদান হূদযন্ত্রের জন্য ক্ষতিকারক বিশেষ করে ক্যাফেইনে।
কফি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়ঃ চা-কফি খেলে ঘুমের পরিমাণ কম হয় একথা কমবেশি অনেকেই জানেন। তবে এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কফি পানের ফলে ঘুমের কতটা সমস্যা হতে পারে তা হয়তো অনুমান করতে পেরেছেন।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যারা নিয়মিত চা-কফি পান করে তাদের তুলনায় যারা চা-কফি পান করে না তারা 79 মিনিট বেশি ঘুমায়।
মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাবঃ উপরে আলোচনা করেছি কফি পান করলে মানসিক ভাবে অনেকেই ফ্রেশ বোধ করে। তবে কফি পানের মাত্রা বেশি হলে এটা উল্টো মানসিক স্বাস্থ্যের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে।
বিশেষ করে কফিতে থাকা ক্যাফেইন এক ধরনের হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে এটা মানুষের মেজাজ খারাপ করার জন্য দায়ী। এছাড়া মাথা ব্যাথা এবং মানসিক ভাবে অস্বস্তি বোধ হতে পারে।
কিডনি বিকল হওয়ার সম্ভাবনাঃ অতিরিক্ত কফি পান এর ফলে আমাদের দেহের কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কফিতে থাকা উপাদান গুলো কিডনির জন্য ক্ষতিকারক। এক্ষেত্রে অবশ্যই অতিরিক্ত কফি পান করা থেকে বিরত থাকবেন। অন্যথায় আপনার কিডনি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সম্মুখীন হবে।
কফি পানের উপকারী তা নিয়ে উপরে অলরেডি আলোচনা করেছি। কফি পান করার ক্ষতিকর দিক গুলো সম্পর্কে এতক্ষণ আলোচনা করলাম। তাই সিদ্ধান্ত আপনার যে আপনার অতিরিক্ত কফি পান করার অভ্যাস থাকলে কফি পানের মাত্রা আপনি কমাবেন কিনা। সুস্থভাবে জীবন যাপন করতে চাইলে অবশ্যই আপনার উচিত অতিরিক্ত পরিমাণে কফি পান ত্যাগ করা হয়।