অনুজীব দ্বারা সংক্রামিত খাদ্য গ্রহণ করার ফলে খাদ্যজনিত রোগের উদ্ভব হয় সাধারণত অপরিচ্ছন্নতা, অসচেতনতা, অপুষ্টি,সঠিকভাবে রান্না না করা এবং সঠিকভাবে খাদ্য গুদামজাত করণের অভাবে খাদ্য দ্রব্যের দূষণ ঘটে থাকে। এসব দূষিত খাদ্য গ্রহণ করার ফলে নানা রকম শারীরিক অসুবিধা বিশেষ করে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা এবং এর সাথে সম্পর্কিত অসুস্থতা দেখা দেয়। এ ধরনের রোগগুলোকেই বলা হয় খাদ্যজনিত অসুস্থতা বা খাদ্যজনিত রোগ।
খাদ্যজনিত অসুস্থতা প্রধানত দুইভাগে হতে পারে।
যথাঃ- ১)খাদ্য দূষণ ২) খাদ্য বিষক্রিয়া।
আমরা অনেকেই মনে করে থাকি খাদ্য দূষণ এবং খাদ্য বিষক্রিয়া একই৷ কিন্তু দুইটাই আলাদা ভাবে বিভক্ত। ▪️খাদ্য দূষণ – খাদ্য দূষণ এক অপ্রত্যাশিত সমস্যা যা আজ মহামারি রূপ লাভ করেছে। খাদ্য দূষণকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়: প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম।
প্রাকৃতিক খাদ্য দূষণ: ভাইরাস, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া যেমন স্টেফাইলোকক্কাস, কম্পাইল ব্যাকটেরিয়া, সালমোনেলা, সিজিলা, লিস্টারিয়া, বুটুলিজম, , E. coli057:H7 ইত্যাদি পরজীবি দ্বারা প্রাকৃতিকভাবে খাদ্যে বিষ (Toxin) তৈরি হয়। এই বিষ হলো toxic products of microorganisms.কৃত্রিম খাদ্য দূষণ: খাদ্য দূষণের আরেকটি রূপ হ’ল মানুষের তৈরি। যেমনঃমুড়িতে ইউরিয়া মেশানো যা মুড়িকে সাদা ও বড় আকারের করে। ইউরিয়া মানব স্বাস্থ্যের জন্য
ক্ষতিকর। এটি আলসার সৃষ্টি করে।সাম্প্রতিককালে একটি চিকিৎসা জরিপে দেখা যায় যে, মুড়িতে ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ সাধারণত চালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ, যা ইউরিয়া ব্যবহারের কারণে বলে প্রতীয়মান হয়। চিকিৎসকরা বৃক্ক বা কিডনি রোগের জন্য ক্যাডমিয়াম দায়ী বলে সর্তক করেন।সবজি উৎপাদনে কীটনাশক ও বলাইনাশক ব্যবহার করা হয়। বেশি বিপজ্জনক কীটনাশকগুলো হলো- সিমবুন, রিনকর্ড, হেপ্টহাক্লোর, সুমিথিয়ন, ম্যালালথিয়ন, অ্যারোম্যাল ইত্যাদি। কীটনাশক প্রয়োগের অপেক্ষমাণ কাল কোনোটির ৩ দিন, কোনোটির ৭ দিন, কোনোটির ২১ দিন, এমনকি কোনোটির ৬ মাস পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিন্তু কৃষকরা তা মানেন না কারণ কীটনাশক প্রয়োগের পর পর সবজি খুব তাজা দেখায়, তাই অধিক লাভের আশায় তারা দ্রুত বিক্রি করে থাকে।
এছাড়াও বিভিন্ন কারণে মানুষ কতৃক খাদ্য দূষণ ঘটে থাকে।
খাদ্য বিষক্রিয়া
সাধারণত রাসায়নিক বিক্রয়ায় কোন বিষের অনুপ্রবেশ এর ফলে ঘটতে পারে।এই বিষ প্রাকৃতিক ভাবে কোন উদ্ভিদ বা প্রাণীতে পাওয়া যেতে পারে অথবা কোনো অনুজীবের ক্রিয়াকলাপেও সৃষ্টি হতে পারে।সাধারণত ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য অনুজীবের বিষাক্ত পদার্থ দ্বারা দূষিত খাদ্য গ্রহণ করলে খাদ্য বিষক্রিয়া ঘটে।খাদ্য বিষক্রিয়াকে দুটি শ্রেনীতে ভাগ করা যায়।যথা:-
ব্যাকটেরিয়া বিষক্রিয়া।
নন-ব্যাকটেরিয়া বিষক্রিয়া।
ব্যাকটেরিয়া বিষক্রিয়াঃ
সাল্মোনেল্লা এক ধরণের ব্যাক্টেরিয়া যেটি সাধারণতঃ পাখী, সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী জন্তুর অন্ত্রের (intestine) মধ্যে থাকে। ভালো করে মাংস রান্না না করলে এই ব্যাক্টেরিয়া নষ্ট হয় না – খাবারের মধ্যে থেকে যায়। এছাড়া অন্য ভাবেও (যেমন, পশু-পাখীর নোংরায় হাত দিয়ে – হাত ভালোভাবে পরিষ্কার না করে সেই হাতে খাবার ধরলে) এটি খাদ্যকে দূষিত করতে পারে। সাল্মোনেল্লা শরীরে প্রবেশ করলে জ্বর, পেটে খিল ধরা, পেট খারাপ ইত্যাদি দেখা দেয়। এটি যথেষ্ট ভয়াবহ – বিষক্রিয়া থেকে সুস্থ হতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগে। হাসপাতালে না গেলে বা সতর্কতা না নিলে এর থেকে মৃত্যুও ঘটতে পারে।
সাধারণভাবে ই-কোলাই (Escherichia coli) ব্যাক্টেরিয়া মানুষ ও জন্তু-জানোয়ারের মধ্যে থাকে। এর কতগুলি প্রজাতি (strain) এক ধরণের বিষ বা টক্সিন তৈরি করে যা শরীরের অন্ত্র, মুত্রগ্রন্থি, রক্ত ইত্যাদি আক্রান্ত করে। এই প্রজাতীর ব্যাক্টেরিয়া দেহে ঢুকলে রক্ত পায়খানা হয়। এটি হলে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত।
ক্লাস্ট্রিডিয়াম বচুলিনাম (Clostridium botulinum) ব্যাক্টেরিয়া মাটিতে পাওয়া যায়। এই ব্যাক্টেরিয়ার টক্সিনে যে খাদ্য-বিষক্রিয়া হয়, তাকে বচুলিজ্ম বলা হয়। স্বাস্থ্যসন্মত ভাবে বোতলে বা কৌটোয় খাবার সংরক্ষণ না করলে এটিতে লোকে আক্রান্ত হয়। যেমন, ঠিকমতো পাস্তুরাইজ্ড না করা মধু থেকে অনেক সময়ে খুব ছোট বাচ্চাদের বচুলিজ্ম হতে পারে। বচুলিজ্ম-এর লক্ষণ হল, পেশীর ক্ষমতা হ্রাস, মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা, ডাবল ভিশন। এছাড়া বমি, পেট খারাপও থাকতে পারে। বচুলিজ্ম-এ স্নায়ু অসার হয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে।এটি হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যাওয়া প্রয়োজন।
টক্সোপ্লাজমা গণ্ডাই (Toxoplasma gondii) বলে এক ধরণের এককোষী জীবানুর জন্য টক্সিপ্লাজমোসিস হয়। সাধারণতঃ ভালোভাবে রান্না না করা মাংস থেকে (এটি বহু পাখী ও জন্তুর মধ্যেই থাকে) এটি শরীরে প্রবেশ করে। অনেক সময়ে পশুপাখীর সংস্পর্শে এলে (বিশেষ করে জীবানু বহনকারী বেড়াল) এটি শরীরে প্রবেশ করতে পারে। মুশকিল হল টক্সিপ্লাজমোসিস-এর লক্ষণ বিশেষ কিছুই নেই। অনেক সময় অল্প ফ্লু-র মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে। মোটামুটিভাবে প্রায় সবাই এতে আক্রান্ত হলে শরীরে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু গর্ভবতী নারী ও যাদের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের ক্ষেত্রে এটি ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। ঠিকমত সময়ে অ্যাণ্টিবায়টিক না দেওয়া হলে এই রোগের সংক্রমণের ফলে, ভ্রুণনষ্ট হওয়া, মৃতশিশু প্রসব, শিশু জীবিত অবস্থায় জন্মালেও – তার মস্তিষ্ক, চোখ ইত্যাদি স্বাভাবিক না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
নন-ব্যাকটেরিয়া বিষক্রিয়াঃ
নন-ব্যাকটেরিয়া বিষক্রিয়া আবার ৩ ধরনের হয়ে থাকে।যথাঃ-
Fungal toxins;
Biochemical toxins;
Chemical poisoning।
ছএাক টক্সিনঃ
বিভিন্ন প্রকার মল্ড, ইষ্ট, মাশরুম এদের মধ্যে কতগুলো উপকারী আর কতগুলো খাদ্য হিসেবে বা খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করণে ব্যবহৃত হয়। এদের মধ্যে কিছু প্রজাতির ছএাক খাদ্য দ্রব্যে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকে।দুধ জাতীয় খাদ্য, ফলের জুস,বেকারী, মাছ, মুরগী ইত্যাদি বিষাক্ত ছএাক দ্বারা সংক্রামিত হতপ পারে।
বায়োকেমিক্যাল টক্সিনঃ
কিছু কিছু খাদ্য-দ্রব্যে প্রাকৃতিক ভাবে কিছু টক্সিন জমা থাকে।যেগুলো রান্নার ফলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।তবে অতিরিক্ত গ্রহণ করলে শারীরিক অসুবিধা হতে পারে।যেমনঃবাধা কপিতে Goitrogen থাকে যার অতিরিক্ত গ্রহণে শোষনে বাধা দেয়।
ক্যামিকেল বিষক্রিয়াঃ
খাদ্য দ্রব্য প্রক্রিয়াজাত করণের সময় ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ সার,কীটনাশক, ওষুধ বিভিন্ন সব্জি বা ফলে ব্যবহার করা হয় সেগুলোর কারণে খাদ্য বিষক্রিয়া হতে পারে। যেমন: সায়ানাইড, জিংক,নিকোটিনিক এসিড ইত্যাদি।
খাদ্য-বিষক্রিয়ার লক্ষণ কি ?
সাধারণভাবে প্রথম লক্ষণ হল বমি বমি ভাব, বমি করা এবং পেট খারাপ হওয়া। ঠিক কখন এই লক্ষণ দেখা দেবে, বা কতটা ভয়াবহ আকারে দেখা দেবে – সেটা নির্ভর করে খাদ্যে কি ছিলো তার উপরে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাস্থ্যের উপরে। এছাড়াও খাদ্য-বিষক্রিয়ার অন্যান্য লক্ষণও আছে।
খাদ্য বিষক্রিয়ার চিকিৎসা
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসা হল কষ্টকে লাঘব করা। ক্ষেত্রবিশেষে অ্যাণ্টিবায়োটিকের প্রয়োগ। বমি বা পেট খারাপ হলে প্রচুর জল ও ইলেক্টরোলাইটস খাওয়া যাতে ডিহাইড্রেশন না হয়। সেইজন্য অনেক সময়ে হাসপাতালে যাওয়াটা প্রয়োজনীয়। পায়খানা কমাবার ওষুধ না খাওয়াটাই বাঞ্ছনীয় – কারণ তাতে ফল উল্টো হতে পারে। বচুলিজ্ম বা ই-কোলাইয়ের ক্ষেত্রে আশু হাসপাতালে যাওয়া প্রয়োজন।