গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা | মাস অনুযায়ী ডায়েট প্ল্যান | 4 মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা

গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা এবং গর্ভস্থ সন্তানের সঠিক পুষ্টি সরবরাহ করার জন্য আরো যেসব তথ্য এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে তা সম্পর্কে জেনে নেয়া প্রতিটি গর্ভবতী মায়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কয়েকজন পুষ্টিবিদ এবং গাইনোকোলজিস্ট দের কাছ থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে পোষ্টটি সাজানো হয়েছে।

গর্ভাবস্থায় মায়ের অতিরিক্ত ক্যালরি প্রয়োজন হয়। কারণ এসময় মায়ের গর্ভে থাকা ভ্রুণের কোষ, প্লাসেন্টা বা অমরা গঠিত হয়। তাই এসময় মায়েদের সাধারণ খাবার এর পাশাপাশি কিছু অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করতে হয়। বাহিরের খাবার না খেয়ে তখন পুষ্টিকর খাবার কে মায়ের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। বিএম আই এর তথ্য অনুযায়ী যেসব মায়েদের ওজন স্বাভাবিক, তাদের ১১ কেজি পর্যন্ত ওজন বাড়াতে বলা হয়। আবার যাদের ওজন প্রয়োজন এর তুলনায় অধিক তাদের ৭ কেজির মতো ওজন বাড়াতে বলা হয়ে থাকে।

গর্ভাবস্থায় ৩ টা পর্যায় আছে, যাদের ট্রাইমিস্টার বলে। প্রতিটি ট্রাইমিস্টার এ ৩ মাস করে অন্তর্ভুক্ত। শেষের মাসে কারো কারো ৩ মাসের কম বা বেশি হতে পারে। প্রথম ৩ মাস কে ফাষ্ট ট্রাইমিস্টার, ৪-৬ মাসকে সেকেন্ড ট্রাইমিস্টার এবং ৭ থেকে ৯ মাস বা বাচ্চা পৃথিবীতে আসার আগে পর্যন্ত সময় কে বলা হয় থার্ড ট্রাইমিস্টার।

আরো পড়ুনঃ গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ, কিভাবে বুঝবেন আপনি প্রেগন্যান্ট?

ট্রাইমিস্টার ভেদে গর্ভবতী মায়ের খাদ্য তালিকা

গর্ভবতী মায়েরা সব ধরনের খাবার কম বেশি খেতে পারেন যদি তার অন্য কোনো সমস্যা বা জটিলতা না থাকে।শুধুমাত্র কিছু কিছু খাবারেই রেস্ট্রিকশন থাকে।তা নিম্নে আলোচনা করা হয়েছে।

প্রথম ট্রাইমিস্টার বা প্রথম থেকে তৃতীয় মাস
২ বা ৩ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা

প্রথম ট্রাইমিস্টার এ মায়েদের শরীরে তেমন পরিবর্তন না হলেও তাদের হরমোনাল কিছু পরিবর্তন শুরু হয়। ত্বকে ব্রণ হওয়া, খাবারে অরুচি বোধ হওয়া, খাবার খেলেই বমি হওয়া, কিছু পছন্দের খাবার ও খেতে অস্বস্তিকর বোধ হওয়া ইত্যাদি নানা লক্ষণ প্রকাশ পায় এসময়। বেশিরভাগ মায়েদের মর্নিং সিকনেশ থাকে। মুড সুইং হয়। এ সব কিছুই নরমাল।

কিন্তু আপনি যদি একদমই না খেতে পারেন বা খেলেই বমি হয়ে যাচ্ছে তখন অবশ্যই একবার ডাক্তার এর পরামর্শ নিয়ে নিবেন। অনেকেই আবার মনে করেন এসময় তার অনেক খাবার খাওয়া প্রয়োজন। আর এটা মনে করে অনেক বেশি খাবার খেয়ে ওজন বাড়িয়ে ফেলেন। ফলে পরবর্তীতে ডায়বেটিস বা অন্যান্য কিছু সমস্যা দেখা দেয়। শরীরে অনেক বেশি মেদ জমে যায়।

তাই গর্ভবতী মায়েদের উচিত ক্ষুধা বোধ হলেই যেনো খাবার গ্রহণ করে। পাশাপাশি দিনে কিছু ঘন্টা পর পর খাবার এর অভ্যাস করতে হবে এবং সম্পূর্ণ প্রেগনেন্সি সময় এ খাওয়ার পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে। এসময় থেকেই শর্করা, প্রোটিন এবং ফলমূল এর একটি তালিকা বানিয়ে তা আস্তে আস্তে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

২ বা ৩ মাসের গর্ভবতী মায়েরা যেসব খাবার খাওয়া শুরু করবেন

১. শুরু থেকেই যে খাবার গুলো মায়ের খাদ্য তালিকায় অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে তা হলো হাফ কেজি পরিমাণ দুধ সকাল বিকাল, বাদাম, ডাবের পানি এবং সবুজ শাকসবজি। কারো যদি ল্যাকটোজ বা দুধের তৈরি খাবারে এলার্জি থাকে তাহলে ডাক্তার এর পরামর্শ অনুযায়ী খাবার তালিকা বানাতে হবে।

২. প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস পরিমাণ পানি পান করবেন।

৩. ২ থেকে ৩ মাসের গর্ভবতী মায়ের ফোলাইট বা ফলিক এসিড খাওয়া শুরু করতে হয়। ফলিক এসিড কিছু প্রাকৃতিক খাবারে পাওয়া যায় যেমন বাদাম, কিসমিস, করোলা, ক্যাপসিকাম, ব্রোকলি, মেথি, পুদিনা, ধনিয়া ইত্যাদি। কিন্তু শুধুমাত্র প্রাকৃতিক খাবার গুলো খেলেই ফলিক এসিডের চাহিদা পূরণ হয় না। তাই চিকিৎসকেরা সাপ্লিমেন্ট হিসেনে ফলিক এসিড এর মেডিসিন নেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

৪. সাধারণত ডাক্তাররা ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক এসিড প্রতিদিন খেতে দেন। ফলিক এসিডের অভাবে বাচ্চাদের কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে কারণ এই সময় বাচ্চাদের মাথা এবং মেরুদন্ড ডেভলপমেন্ট শুরু হয়।

গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ট্রাইমিস্টার বা চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ মাসে কি কি খাবেন?

সাধারণ প্রতিদিন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক সাধারণ নারীর ২২০০ ক্যালরি খাবার প্রয়োজন হয়। গর্ভবতী হলে এর পরিমাণ বাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে ২৫০০ ক্যালরিতে। অতিরিক্ত ২০০ থেকে ৩০০ ক্যালরি বেশি খাওয়া প্রয়োজন দ্বিতীয় ট্রাইমিস্টারে।

১. এসময় ভিটামিন ডি, ওমেগা ফ্যাটি এসিড বেশি করে খেতে হয়। কারণ এ সময় গর্ভস্থ শিশুর চোখ এবং মস্তিষ্কের গঠন হয়। এই অঙ্গগুলো পরিপূর্ণভাবে বিকাশ লাভের জন্য এই দুটি পুষ্টি উপাদান অনেক প্রয়োজনীয়।

২. ভিটামিন ডি পাওয়া যায় সূর্যের আলো, দই, দুধ, বাদামী চাল এবং গমে।

৩. ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায় সামুদ্রিক মাছ জাতীয় খাবার, তিসির তেল ইত্যাদিতে।সালাদ খাওয়ার সময় দু চামচ তেল এতে দিয়ে খেতে পারেন।

৪. প্রচুর পরিমাণে মাছ,এবং আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে। কারণ এসময় বাচ্চার থাইরয়েড গ্ল্যান্ড কাজ করতে শুরু করে।

৫. এসময় শিশুর হাড়,মাংস এবং কোষ পরিপক্ক হতে শুরু করে তাই ২য় ট্রাইমিস্টার এর শুরু থেকেই প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম খেতে হবে। ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় দুধ এবং দুধের তৈরি খাবার খেতে, দই, চিজ, আইসক্রিম ইত্যাদিতে।

৬. এসময় প্রতিদিন আয়রন লাগে ৪০ মি.গ্রাম। কিছু ভিটামিন এবং মিনারেলস অতিরিক্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হয়।এসব কোনোটির যেনো ঘাটতি না হয় তাই মেডিসিন হিসেবে ডাক্তাররা এসময় তিন ধরনের ঔষধ প্রেসক্রাইব করে থাকেন। ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং ভিটামিন ট্যাবলেট।

৭. নিয়মিত হাটাচলা করবেন। কিন্তু অনেক জোরে হাটাহাটি করবেন না।

আরো পড়ুনঃ নরমাল ডেলিভারি হওয়ার উপায় এবং করণীয়

গর্ভাবস্থার তৃতীয় ট্রাইমিস্টার বা সপ্তম থেকে নবম মাস বা শিশু জন্মের আগ পর্যন্ত কি কি খাওয়া উচিত

৭ম মাস থেকে বাচ্চা জন্মানোর আগে পর্যন্ত সময় টাকে তৃতীয় ট্রাইমিস্টার হিসেবে গননা করা হয়।

১. এসময় প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে।পানির সাথে কখনো কখনো ডাব খেতে পারেন। ডাবে প্রচুর পরিমাণে মিনারেলস থাকে যা এসময় প্লাসেন্টার লিকুইড এর ঘাটতি কমাতে সাহায্য করে।অর্থাৎ বাচ্চা যেনো পানিশূন্য না হয়ে পড়ে সে জন্যই প্রচুর পানি এসময় প্রয়োজন হয়ে থাকে।

২. বেশি বেশি আঁশযুক্ত ফল এবং শাকসবজি খেতে হবে। কারণ এসময় টাতে কোষ্ঠকাঠিন্য এর সমস্যা বেড়ে যায়। আঁশযুক্ত খাবার পায়খানা নরম করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য এর সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্তি দেয়। এছাড়াও আদা চা ও কখনো কখনো এই সমস্যার সমাধান করতে পারে।

৩. এসময় হাটা চলায় কষ্ট হলেও নিয়মিত ২০-৩০ মিনিট হাটার পরামর্শ দিয়ে থাকেন ডাক্তারেরা। পাশাপাশি ডাক্তার এর পরামর্শ অনুযায়ী আপনি কিছু এক্সারসাইজ ও করতে পারেন।

চলুন এক নজরে দেখে নেই উপরোক্ত তথ্য সমূহ এবং গর্ভবতী মায়ের খাবারগুলোর একটি তালিকা :

গর্ভবতী মায়ের ফল খাবার তালিকা

  • আপেল
  • কলা
  • পেয়ারা
  • আনার
  • নাশপাতি
  • জাম
  • মাল্টা
  • আমড়া
  • আম
  • কাঠাল
  • ড্রাগন
  • ডাব
  • লেবু
  • শসা
  • অ্যাভোকাডো ইত্যাদি

গর্ভবতী মায়ের সবজি খাবার তালিকা

  • লাউ
  • সিম
  • মিষ্টি কুমড়া
  • করোলা
  • ঢেড়স
  • ব্রকলি
  • ক্যাপসিকাম
  • বরবটি
  • পুদিনা
  • ধনিয়া
  • লাল শাক
  • পাট শাক
  • কলমি শাক

এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সবুজ শাক এবং ইত্যাদি।

গর্ভবতী মায়ের ঔষধ

গর্ভাবস্থায় শুরু থেকেই ফলিক এসিড ঔষধ হিসেবে দেয়া হয়।

কারো যদি গ্যাস্ট্রিক এর সমস্যা থাকে তাহলে দু’বেলা করে গ্যাস এর ঔষধ দেয়া হয়।

৩ মাস পর থেকে ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং ভিটামিন এর ঔষধ দেয়া হয়।

শারীরিক প্রকারভেদ অনুযায়ী অনেককে মাল্টিভিটামিন দেয়া হয়।

কোষ্ঠকাঠিন্য এর সমস্যা থাকলে সিরাপ খেতে দিয়ে থাকেন।

কারো প্রচুর বমি হলে সেটি নিয়ন্ত্রণে ঔষধ দেয়া হয়।

কারো গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে ডাক্তার সেটার মাত্রা বুঝে সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে থাকার মেডিসিন বা ইনসুলিন দিয়ে থাকেন।

কারো ওজন অনেক বেশি হয়ে থাকলে সেটি নিয়ন্ত্রণের জন্য ঔষধ ও দিয়ে থাকেন প্রয়োজন হলে।
অনেকের অধিক চুলকানি বা এলার্জির সমস্যা থাকলে সেটি দূর করবার ঔষধ ও ডাক্তার দিয়ে থাকেন।

কারো যদি জ্বর,সর্দিকাশি হয় সেক্ষেত্রে ডাক্তার এর পরামর্শ অনুযায়ী প্যারাসিটামল বা নাপা জাতীয় ঔষধ খাওয়া যেতে পারে।

একটা বিষয় মনে রাখবেন, এই সময় টি অত্যন্ত জটিল একটি সময়। ডাক্তার এর পরামর্শ ছাড়া নিজ থেকে কোনো ঔষধই তখন সেবন করা উচিত নয়। যেকোনো সমস্যায় অবশ্যই বসে না থেকে ডাক্তার এর পরামর্শ নিতে হবে।

গর্ভাবস্থায় কি কি খাওয়া যাবেনা

১. ধূমপান বা মদ্যপান একদমই করা যাবেনা। এতে করে কম ওজনের বা প্রি মেচিউর বেবি, এমনকি মৃত সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

২. ক্যাফেইন সমৃদ্ধ খাবার কম খেতে হবে। বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে সকাল এবং বিকালে চা বা কফি খাবার একটা প্রচলন রয়েছে। গর্ভবতী মায়েদের এসময় চা এর পরিমাণ একদম কমিয়ে আনা উচিত। কফি না খেলেই ভালো। এবং মাঝারি সাইজের কাপে ২ কাপের বেশি চা না খাওয়াই উচিত।

৩. ফলের মধ্যে আনারস এবং পেপে না খাওয়াই ভালো।

৪. ভারী কোনো এক্সারসাইজ করা থেকে বিরত থাকবেন।

সন্তান গর্ভে থাকার সময়কালীন ৯ থেকে ১০ মাস একটি মার জন্য অনেক নতুন একটি সময়।বিশেষ করে যারা নতুন মা হচ্ছেন। এসময় বেশি বেশি হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করবেন। একদম আলসেমি তে দিন পার না করে রেস্ট এর পাশাপাশি বাকি সময় টা বাসায় কাজে লাগিয়ে আপনার পছন্দের কাজ করুন। সর্বোপরি স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ এর পাশাপাশি প্রতিটি দিন নতুন নতুন এক্সপেরিয়ান্স এর সাথে সময় পার করুন।

আরো পড়ুনঃ

5/5 - (14 Reviews)
Subna Islam
Subna Islam
Articles: 78

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *