রসুন এর উপকারিতা সম্পর্কে আজকের পোস্টে বিস্তারিত জানতে পারবেন। রসুন সবচেয়ে বেশি ভেষজ গুন সমৃদ্ধ মশলা জাতীয় খাবার। এতে আমিষ প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-সি থাকে।
রসুন হল পেয়াজ জাতীয় একটি ঝঁঝালো সবজি যা রান্নার মসলা ও ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তবে বর্তমানে রসুনকে রান্নার মসলা হিসেবে বেশি ব্যবহার করা হলেও প্রাচীন ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে জানা যায় তখন রসুন কিন্তু শুধু মাত্র বিভিন্ন অসুখ সারানোর জন্যই ব্যবহার হতো। মিশরীয়‚ ব্যাবিলনীয়‚ গ্রিক‚ রোমান এবং চৈনিক সভ্যতায় ওষুধ হিসেবে রসুনের ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া গেছে |
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৫ লক্ষ্য টন রসুন উৎপাদিত হয়ে থাকে। রসুন সবচেয়ে বেশি ভেষজ গুন সমৃদ্ধ মশলা জাতীয় খাবার। এতে আমিষ প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-সি থাকে। আজ আমার এই পোস্টে রসুনের উপকারিতা সম্পর্কে জানবঃ
রসুনের পুষ্টিগুণ
রসুনের পুষ্টি উপাদান | প্রতি ১০০ গ্রাম |
ক্যালোরি | 130 কিলোবাইট |
প্রোটিন | 6.5 গ্রাম |
চর্বি | 0.5 গ্রাম |
কার্বোহাইড্রেট | 29.9 গ্রাম |
জল | 60 গ্রাম |
ম্যাগনেসিয়াম | 30 মিগ্রা |
পটাসিয়াম | 260 মিলিগ্রাম |
ক্লোরিন | 30 মিগ্রা |
সোডিয়াম | 17 মিগ্রা |
ফসফরাস | 100 মিলিগ্রাম |
ক্যালসিয়াম | 180 মিলিগ্রাম |
ভিটামিন-সি | ১০ মিলিগ্রাম |
সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড | 0.1 গ্রাম |
অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড | 0.1 গ্রাম |
জৈব অ্যাসিড | 0.1 গ্রাম |
ফাইবার | 1.5 গ্রাম |
স্টার্ক | 26 গ্রাম |
রসুনের ভেষজ ব্যবহার
রসুন বিশ্বে বাণিজ্যিক ভেষজ হিসাবে সফলতম। ২০০৪ সালে ২৭ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি ভেষজ রসুনজাত ওষুধ বিক্রয় হয়।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, একটি মাঝারি সাইজের রসুনে এক লাখ ইউনিট পেনিসিলিনের সমান অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা রয়েছে। শুধু তাই নয়, ব্যাকটেরিয়া ও প্রোটোজোয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি অ্যামিবিক ডিসেনট্রি নির্মূলের ক্ষেত্রে রসুন বেশ কার্যকরী।
আধুনিক ভেষজ চিকিৎসায় রসুনের ব্যবহার, সর্দি, কাশি, জ্বর, ফ্লু, ব্রঙ্কাইটিস, কৃমি, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য পরিপাকের সমস্যাসহ লিভার ও পিত্তথলির নানা উপসর্গ দূর করতে রসুন খাওয়ার পরামর্শ দেন। দেহের রোগ সংক্রমণ দূর করার জন্য এক সঙ্গে তিন কোয়া রসুন দিনে তিন থেকে চার বার চিবিয়ে খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। রক্তের চাপ ও রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর জন্য প্রতি দিন তিন থেকে ১০ কোয়া রসুন খেতে পারেন। তা ছাড়া রসুনের জল সেবন করতে হলে ছয় কোয়া রসুন পিষে এককাপ ঠান্ডা জলে ৬ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। তার পর ভালো ভাবে ছেঁকে রসুন জল সেবন করুন।
রসুনের উপকারিতা
হৃদরোগ প্রতিরোধেঃ প্রতিদিন রসুন খেলে হৃদরোগ ও হৃদরোগ জনিত স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে যায়।
হৃৎপিণ্ডের সুস্থতায়ঃ হৃৎপিণ্ডের সুস্থতায় রসুন খুবই উপকারি। রসুন কোলেস্টেরল কমাতে খুবই সহায়ক। যা হার্ট এট্যাকের ঝুঁকি কমাও ও হার্টকে সুস্থ রাখে।
স্মৃতিশক্তিবর্ধকঃ নিয়মিত ২-৩ কোয়া রসুন খেলে স্মরণশক্তি বৃদ্ধি পায়।
যৌনশক্তি বৃদ্ধিকারকঃ রসুন শুক্র ও শক্তিবর্দ্ধক হিসাবে কাজ করে। সুস্থ বীর্য তৈরিতে রসুনের জুড়ি মেলা ভার। যৌন অক্ষমতার ক্ষেত্রে রসুন খুব ভালো ফল দিয়ে থাকে৷ যৌন ইচ্ছা ফিরে আনার ক্ষেত্রে এর ব্যবহার খুবই কার্যকরী৷ প্রতিদিন নিয়ম করে কয়েক কোষ কাঁচা রসুন খেলে স্ত্রী-পুরুষ উভয়েরই যৌবন দীর্ঘস্থায়ি হয়।
অ্যান্টিবায়োটিকের মত কাজ করেঃ রসুন কে বলা হয় প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক। গবেষণায় দেখা গেছে, খালিপেটে রসুন খেলে তা অ্যান্টিবায়োটিকের মত কাজ করে। রসুনে ”এ্যালিসিন” নামক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে যা এন্টি ব্যাকটেরিয়াল, এন্টি ভাইরাল হিসেবে কাজ করে। এটি যক্ষা, আমাশয়, টায়ফয়েড,কলেরার রোগ জীবাণু ধবংস করে।
রসুনে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকেঃ রসুনে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে যা গ্রন্থি, মলাশয়, মলদ্বার, কন্ঠনালী, ত্বকের টিউমার ও ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। এন্টিক্সিডেন্ট অকাল বার্ধক্য রোধ করে।
অন্ত্রের জন্য ঔষধিঃ রসুন হজমে সাহায্য করে। খালি পেটে রসুন খাওয়ার ফলে যকৃত এবং মূত্রাশয় সঠিকভাবে নিজ নিজ কার্য সম্পাদন করে। এছাড়াও নিয়মিত রসুন খেলে পেটের বিভিন্ন সমস্যা দূর হয় যেমন-ডায়রিয়া। এটা হজম ও ক্ষুধার উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এটি স্ট্রেস দূর করতেও সক্ষম। স্ট্রেস বা চাপের কারনে আমাদের গ্যাস্ট্রিক এর সমস্যায় পরতে হয়। তাই, খালি পেটে রসুন খেলে এটি আমাদের স্নায়বিক চাপ কমিয়ে এ সকল সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে।
যক্ষা প্রতিরোধকঃ রসুন যক্ষা রোধ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
স্কার্ভি রোগের প্রতিষেধকঃ রসুনে ভিটামিন সি থাকে যা স্কার্ভি রোগের প্রতিরোধক ও প্রতিশোধক হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও এটি রক্তনালী নমনীয় করে রক্ত চলাচল সহজ করে।
রোগের প্রতিরোধকঃ রসুন যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, ফুসফুসের কনজেশন, হাপানি, হুপিং কাশি ইত্যাদি প্রতিরোধ করে।
বাতের চিকিৎসায়ঃ নিয়মিত ২-৩ কোয়া রসুন খেলে গিটের বাত সেরে যায়।
রক্তনালীর সুরক্ষায়ঃ রক্তনালীর ভিতর চর্বি ও ময়লা জমে নালীর গাত্র সরু হয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করে। রক্তনালীর গায়ে রক্ত কোষগুলোর আটকে যাওয়া প্রতিরোধ করে। রক্তনালীকে স্ফীত হতে সাহায্য করে। রক্তনালীর ভিতর রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে। ধমনীতে ব্লক সৃষ্টি হতে দেয় না, ফলে হার্ট সহজে রক্ত সঞ্চালন করতে পারে।
রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়ঃ প্রতিদিন রসুনের কয়েকটি কোয়া কাঁচা সেবনে কেলেস্টেরলের মাত্রা কম থাকে। পরীক্ষায় দেখা গেছে ৪ সপ্তাহ রসুন খাওয়ার পর কোলেষ্টেরল ১২% কমে যায়।
উচ্চরক্তচাপ /হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণেঃ অসংখ্য মানুষ যারা উচ্চ রক্তচাপের শিকার তারা দেখেছেন, রসুন খাওয়ার ফলে তাদের উচ্চ রক্তচাপের উপসর্গ উপশম হয়। রসুন খাওয়ার ফলে তারা শরীরে ভাল পরিবর্তন দেখতে পায়। দিনে চার কোয়া করে খেলে সে রক্তচাপ কমানোর ওষুধের সঙ্গেও পাল্লা দিতে পারে কিছু ক্ষেত্রে৷ রসুনে ”এ্যাজোইন” নামক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে যাহা রক্ত পাতলা রাখতে সাহায্য করে, ফলে রক্ত চলাচল সহজ হয়। এভাবে উচ্চ রক্তচাপ কমিয়ে আনে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করেঃ ব্লাড সুগার কমিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রন করে।
চোখ ও দাঁতের যত্নেঃ রসুন চোখ ও দাঁত ভাল রাখে। রসুন চোখের ছানি পড়ার হাত থেকে রক্ষা করে। আবার দাঁতের ব্যথা সারাতে রসুন সহায়তা করে থাকে। কাঁচা রসুন চিবিয়ে খেলে দাঁতের ব্যথা ভাল হয়।
ত্বকের যত্নে রসুনঃ ত্বকের যত্নেও রসুনের জুড়ি নেই। ব্রণ এবং ব্রণের দাগ নিমিষে দূর করে দিতে পারে এই রসুন।
পেটের কৃমি নিরাময়েঃ রসুন পেটের কৃমি নিরাময়ে অনেক উপকারী। রসুন দেহের অভ্যন্তরীণ ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া এবং কৃমি ধ্বংস করে।
আমাদের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট আদার উপকারিতা এখনই দেখে নিন।
রক্ত পরিষ্কার রাখেঃ রসুন রক্ত পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে। রক্ত পরিষ্কারে উপকারিতা প্রতিদিন সকালে রসুনের দুটি কোয়া ও এক গ্লাস পরিমাণ গরম পানি সেবন করতে হবে। আর দিনে প্রচুর পরিমাণ পানি পান করতে হবে। এতে রক্ত পরিষ্কার হবে এবং ত্বক ভালো থাকবে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করেঃ রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে প্রতিদিন সকালে নাস্তা শেষে দুই তিন কোয়া রসুন খেতে হবে। এর ফলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং ঋতু পরিবর্তনের সময় স্বাস্থ্যগত সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। রসুন গলা ব্যথা, গলা বসে যাওয়া, হাপানী, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, কাশি, হুপিং কাশি ও ঠান্ডা লাগা ভাল করে।
জ্বর ও ঠান্ডার মহাঔষধঃ প্রায়ই ঠান্ডা ও জ্বরে পড়েন এমন ব্যক্তিদের জন্য রসুন হতে পারে এক মহৌষধ। শরীর থেকে জ্বর আর ঠান্ডা দূর করতে প্রতিদিন দু-তিন কোয়া রসুন খাদ্য তালিকায় রাখুন। উপকার পাবেন।
ক্যান্সার প্রতিরোধে রসুনঃ কোলন/প্রোস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধ করে থাকে এই রসুন। গলব্লাডার ক্যানসার হওয়া থেকেও মুক্ত রাখে। মেয়েদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। এমনকি রেক্টাল ক্যানসারের হাত থেকে রক্ষা করে। এই রসুন ইস্ট ইনফেকশন দূর করতে সাহায্য করে। এছাড়া নিয়মিত রসুন সেবনে শরীরে সব ধরনের ক্যানসার প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়।
তবে মনে রাখতে হবে,অতিরিক্ত রসুন খেলে রক্ত সহজে জমাট বাঁধে না যা সার্জারীর জন্য বিপদজনক, গর্ভাবস্থায় ও দুগ্ধদানকারী মাতা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কাঁচা রসুন খাবেন না।
রসুন হোক আপনার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় থাকা এক ভেষজ ঔষধ।
খাদ্যের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানতে আমাদের সঙ্গে থাকুন। সুস্থ থাকুন।