দৈনন্দিন জীবনে আমরা যেরকম খাদ্যতালিকা মেইনটেন করে থাকি, গর্ভাবস্থায় এর থেকে বেশি পুষ্টি ও গুনাগুণ মেনটেইন করে খাদ্য তালিকা তৈরি করার প্রয়োজন হয়ে থাকে। সে খাদ্য তালিকার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো নিয়মিত দুধ পান করা। আজকের পোস্টে আমরা গর্ভাবস্থায় দুধ খাওয়ার উপকারিতা ও সঠিক নিয়ম সম্পর্কে জানবো।
দুধের পুষ্টিমানঃ
দুধের মধ্যে এমন কিছু খাদ্য উপাদান রয়েছে যার জন্য একে আদর্শ খাবার বলা হয়ে থাকে।
এর প্রধান উপাদান হলো ল্যাকটোজ, যা মানুষের শরীরের দৈহিক গঠন, বিকাশ ও মেধা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও প্রানীভেদে দুধের পুষ্টিমান কিছুটা ভিন্ন হয়। গরু, মহিষ, ছাগল, ঘোড়া, গাধা ইত্যাদি নানা প্রানী থেকে দুধ সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ বা ভারতীয় উপমহাদেশে বেশিরভাগ জায়গায় গরু, ছাগল কিংবা মহিষ এর দুধই বেশি খাওয়া হয়।
দুধের মধ্যে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদান সমূহ হলোঃ ভিটামিন, স্নেহ পর্দাথ, ফ্যাট, বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ, অ্যামাইনো এসিড, ক্রোমিয়াম, ম্যাংগানিজ, আয়রণ, কপার, জিংক, সেলেনিয়াম, কোবাল্ট, ইত্যাদি।
আরো পড়ুনঃ দুধের পুষ্টি উপাদান কি কি
গর্ভাবস্থায় দুধ খাওয়ার উপকারিতা
গর্ভাবস্থায় গর্ভের সন্তান এর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য দুধ পানের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
১. গর্ভাবস্থার শুরু থেকে দুধ পান শুরু করলে প্রিমেচিউর প্রসব হওয়ার আশঙ্কা কমে প্রায় ২১ শতাংশ। একলামশিয়া হওয়ার সম্ভাবনাও কমে প্রায় ২০ শতাংশ।
২. দুধে উপস্থিত ভিটামিন এ, ভিটামিন বি১২, ক্যালসিয়ামসহ পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে যা শিশুর বিকাশে ভূমিকা রাখে।
৩. গর্ভাবস্থায় মায়েরা একটি সাধারণ সমস্যায় ভুগেন সেটি হলো অনিদ্রা। অনিদ্রা থেকে শারীরিক নানা জটিলতার সূত্রপাত হয়। যেহেতু তখন নিদ্রার কোনো ঔষধ সেবন ও সম্ভব হয়না তাই রাতের বেলা এক গ্লাস দুধ খেয়ে ঘুমালে এই সমস্যা অনেকটাই দূর করা সম্ভব হয়।
৪. গর্ভের শিশুর হাড় এবং দাঁতের বিকাশে দুধ অনেক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। দুধে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম ও খনিজ উপাদান শিশু হাড়ের গঠন মজবুত করতে সাহায্য করে।
৫. দুধে রয়েছে উৎকৃষ্ট মানের প্রোটিন যা গর্ভের শিশুর মাংসপেশি গঠন এবং শারীরিক গড়ন সুন্দর করতে সাহায্য করে।
৬. পটাসিয়াম ম্যাগনেসিয়াম ফসফরাস ও ভিটামিন নিয়মিত দুধ পান করলে এসব পুষ্টি ও পাবেন যা গর্ভের সন্তানের মানসিক বিকাশ ও শারীরিক বৃদ্ধি করে।
৭. কোনো গর্ভবতী নারী যদি আন্ডার ওয়েট হয়ে থাকেন অথবা খাওয়া দাওয়া তুলনামূলক কম করে থাকেন তাদের গর্ভের বাচ্চাও আন্ডার ওয়েট হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। এমতাবস্থায়, আপনি যদি দিনের বেলা সকালের নাস্তায় দুধের সাথে বাদামের গুড়ো মিক্স করে খান তাহলে মা ও শিশুর ওজন ঠিক রাখা সম্ভব হবে।
৮. গর্ভাবস্থায় শরীরে প্রজেস্টেরন হরমোনের জন্য শরীরে অনেক বেশি ক্লান্তি অনুভব হয়। নিয়মিত দুধ খেলে শরীরের ক্লান্তি ভাব দূর হয়ে যায় এবং শরীরের শক্তি সঞ্চার ঘটে।
৯. গর্ভাবস্থায় কোন নারী যদি ঠান্ডা জনিত জটিলতায় ভোগেন তাহলে সেটা গর্ভের শিশুর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এই সমস্যা থেকে বাঁচতে রাতে ঘুমানোর পূর্বে গরম দুধ পান করার অভ্যাস করা উচিত।
১০. এসময়কার আরেকটির জটিল সমস্যা হল হজমের সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা। এই সমস্যাগুলো দূর করার জন্য নিয়মিত সকালে এবং রাতে এক কাপ করে গরম দুধ পান করতে পারেন। যা আপনার হজম শক্তিকে ত্বরান্বিত করবে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা দূর করতে সহায়তা করবে।
আরো পড়ুনঃ দুধের উপকারিতা
গর্ভাবস্থায় দুধ খাওয়ার সঠিক নিয়মঃ
১. গর্ভাবস্থায় সকালে বা রাতে যেকোনো সময়ই দুধ পান করেন না কেনো একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, যেকোনো খাবার গ্রহণের পর পরই আপনি দুধ পান করবেন না। এবং খাবার শুরু করার আগেও দুধ পান করবেন না। খাওয়া শেষ করে ১০-১৫ মিনিট রেস্ট নিয়ে এরপর দুধ পান করুন। এতে আপনার গ্যাস, এসিডিটি এমনকি হজমের সমস্যা হবেনা।
২. কখনোই প্রচন্ড গরম দুধ পান করবেন না, এতে গর্ভবতী মায়ের শরীর অনেক গরম হয়ে যায়, যা গর্ভের শিশুর জন্য মোটেও ভালো না। অন্যদিকে ফ্রিজ থেকে বের করেই ঠান্ডা দুধ ও খাওয়া ঠিক না। তাই, গর্ভাবস্থায় ঈষদুষ্ণ দুধ পান করুন।
৩. যাদের দুধে এলার্জি আছে তারা লো ফ্যাট যুক্ত দুধ পান করুন। তাহলে গ্যাস বা এসিডিটির সমস্যা হবেনা।
৪. গর্ভের শিশুর ওজন বৃদ্ধি করতে দুধের সাথে বাদামের গুড়ো মিশিয়ে খেতে পারেন।
৫. ঠান্ডা জনিত সমস্যা থাকলে দুধের সাথে এক চিমটি হলুদ মিক্স করে খেতে পারেন।
৬. দিনে বা রাতে ১০০-২০০ মিলিলিটার বা এর কিছু অধিক পরিমান বা দু’ গ্লাস পরিমান দুধ পান করাই যথেষ্ট একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য।
৭. কারো যদি ল্যাকটোজ অর্থাৎ দুধের যে প্রধান উপাদান সেটিতে এলার্জি থাকে তাহলে অবশ্যই ডাক্তার এর পরামর্শ নিতে হবে।
৮. দুধে অ্যামাইনো এসিড রয়েছে যা মস্তিষ্কের সেরোটোনিন হরমোন নিঃসরণের সহায়তা করে। এই হরমোন টি গর্ভবতী নারী এবং গর্ভের সন্তানের জন্য অনেক প্রয়োজনীয়।
৯. দুধ খাওয়ার উপযুক্ত সময় হলো সকালের নাস্তার পর অথবা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে।
গর্ভাবস্থায় নানা সুবিধা অসুবিধার কথা বিবেচনা করে মানুষ দিনে বা রাতে দুধ খেতে পারেন। সেসব সম্পর্কে নিচে তথ্য দেয়া হলোঃ
১. প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর জন্য গর্ভাবস্থায় দিনের বেলা সকালের নাস্তায় দুধ পান করা উচিত।
২. গর্ভাবস্থার প্রথম কয়েক মাস ডাক্তাররা বেশি বিশ্রামের পরামর্শ দিলেও শেষের তিন মাস বা লাস্ট ত্রৈমাসিকে কিছু ব্যায়াম ও হাটাচলা করবার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এমতাবস্থায়, আপনি যদি দিনের বেলায় ব্যায়ামগুলো করতে চান, তাহলে আপনার সকালে দুধ খাওয়া প্রয়োজন সে ক্ষেত্রে আপনার শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তির সঞ্চার হবে যা আপনাকে দীর্ঘদিন ব্যায়াম করতে সাহায্য করবে।
৩. কারো যদি অনেক বেশি গ্যাস, এসিডিটি বা হজমের সমস্যা থাকে তারা রাতের বেলা ঘুমানোর আগে দুধ পান করুন।
৪. রাতে ঘুম কম হলে বা অনিদ্রা জনিত সমস্যা থাকলে রাতে ঘুমানোর আগে দুধ পান করতে পারেন।
৫. এছাড়াও রাতে দুধ পান করলে সারাদিনের ক্লান্তিভাব দূর হয়।
গর্ভাবস্থায় মায়েদের দুধ পানে কোনোরকম সমস্যা থাকলে তা ডাক্তার এর সাথে পরামর্শ করে সমাধান করে নেয়ার চেষ্টা করুন। কারণ এই সময় দুধ খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি থাকে।
আরো পড়ুনঃ