দই বা দধি হল এক ধরনের দুগ্ধজাত খাদ্য যা দুধের ব্যাকটেরিয়া গাজন হতে প্রস্তুত করা হয়। মানুষ ৪৫০০ বছর ধরে দই প্রস্তুত করছে এবং তা খেয়ে আসছে। দই প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, রাইবোফ্ল্যাভিন, ভিটামিন B6 এবং ভিটামিন B12 এ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সারা পৃথিবীতেই পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে এর সুনাম রয়েছে।
কিন্তু শুধু পুষ্টিকর খাবার ই নয় ত্বক পরিচর্যায় টক দই এর ভূমিকা যে কত টা গুরুত্বপূর্ণ তা হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। রুপচর্চার জন্য এই টক দই প্রায় সব ধরনের ত্বকের জন্যই খুব ভালো।
এটা ত্বকে যেমন ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া যায়, তেমনি খুব সহজে ঘরে থাকা অন্যান্য উপকরণ এর সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করলে ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা খুব সহজেই দূর করতে পারে। মুখে নিয়মিত টক দই ব্যবহারে ত্বক হয় আরও ফর্সা, দূর হয় ত্বকের অনাকাঙ্ক্ষিত দাগ, পিগমেন্টেশন, স্কিন হয় টান টান, এমনকি পিম্পলের সমস্যা থেকেও মুক্তি পাওয়া যায় এই টক দই ব্যবহারের মাধ্যমে।
টক দই আমাদের ত্বকের জন্য আসলেই অনেক উপকারী। এটি নিয়মিত ব্যবহারে আমরা ত্বকের হাজারো সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারি। তাহলে আসুন জেনে নেয়া যাক টক দই মুখে মাখার উপকারিতা এবং কিভাবে ত্বকের যত্নে টক দই ব্যবহার করতে হবে –
টক দই রেসিপি সম্পর্কে জানতে আমারই লেখা এই প্রতিবেদনটি পড়ুন:
টক দই মুখে মাখার উপকারিতা
শুষ্ক ত্বকের জন্য টক দই
যাদের অমসৃণ ও রুক্ষ ত্বক তাদের মন খারাপ করার কিছুই নেই। কারণ সেই সকল ত্বকের জন্য টক দই খুবই উপকারী। বিভিন্ন পদ্ধতিতে টক দই দিয়ে শুষ্ক ত্বকের জন্য ফেইস প্যাক তৈরি করা যায়। যেমন~
পদ্ধতি ১- এক কাপ টক দই ও দুটি কলা চটকে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। গোসলের আগে মুখে বা চাইলে পুরো শরীরের ত্বকে লাগিয়ে নিতে হবে। এরপর ২০ মিনিট অপেক্ষা করে গোসল করে ফেলতে হবে। নিজেই উপকারীতা বুঝতে পারবেন। দেখবেন ত্বক কতটা মসৃণ হয়ে গেছে।
পদ্ধতি ২- এই প্যাক এর জন্য লাগবে ২ চামচ টক দই, সাথে এক চামচ মধু। উপাদান দুটি ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে মুখ এবং পারলে গলায় ও লাগিয়ে নিতে হবে। ১৫-২০ মিনিট পরে ধুয়ে ফেলতে হবে। মধু প্রাকৃতিক ভাবে ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করতে সাহায্য করে। ত্বককে করে মসৃণ।
পদ্ধতি ৩- ২ চামচ টক দই এর সাথে নিতে হবে ২ চামচ দুধ। উপাদান দুটি ভালোভাবে মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে রাখতে হবে ২০ মিনিট। এই প্যাক টি ত্বককে যেমন মসৃণ করে, সাথে সাথে স্কিন ডিপ ক্লিন করতে সাহায্য করে।
আরো পড়ুনঃ দুধের উপকারিতা, দুধের পুষ্টি উপাদান কি কি
তৈলাক্ত ত্বকের জন্য টক দই
তৈলাক্ত ত্বকের জন্য টক দই যেন আশীর্বাদ স্বরুপ। তৈলাক্ত ত্বকে সাধারণত একটু বেশি সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। টক দই এর উপযুক্ত ব্যবহার এই সকল সমস্যার সমাধান করতে পারে। তৈলাক্ত ত্বকের জন্য টক দই এর ফেইস প্যাক তৈরির পদ্ধতি হলো ~
পদ্ধতি ১- দুই চামচ টক দই এর সাথে নিতে হবে এক চামচ মুলতানি মাটি। আমরা সবাই জানি মুলতানি মাটি তৈলাক্ত ত্বকের জন্য কত টা উপকারী। মুলতানি মাটি ত্বকের অতিরিক্ত তেল শোষণ করে নেয়।যার কারণে পিম্পল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক টাই কমে যায়।
টক দই ও মুলতানি মাটি ভালো ভাবে মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে রেখে দিতে হবে ১৫ মিনিট। এরপর নরমাল পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
আরো পড়ুনঃ মুলতানি মাটি দিয়ে ফর্সা হওয়ার উপায়, ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধির উপায়
পদ্ধতি ২- এই প্যাক তৈরির জন্য টক দই এর সাথে নিতে হবে পরিমাণ মতো বেসন।একটি পেস্ট তৈরি করতে হবে।মুখে লাগিয়ে রাখতে হবে ১৫ মিনিট।
বেসন ও আমাদের ত্বকের অতিরিক্ত তেল শোষণ করে নেয়। এবং সাথে সাথে স্কিন করে উজ্জ্বল।
ব্রণ দূর করতে টক দই
মুখের মধ্যে যদি ব্রণ, ফুসকুড়ি, র্যাশ হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে টক দই এর সাথে নিতে হবে এক চমটি হলুদ ভালো হয় যদি কস্তুরি হলুদ নেয়া যায় কস্তুরি হলুদ না থাকলে নরমাল কাচা হলুদ বাটা বা হলুদ পাউডার নিয়ে মিশিয়ে ত্বকে লাগিয়ে নিতে হবে। ১০-১৫ মিনিট পরে নরমাল পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
হলুদের মধ্যে যেহেতু এন্টিস্যাপটিক উপাদান আছে তাই এর মাধ্যমে যে কোনো ব্রণ, ফুসকুড়ি বা ইনফেকশন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
এছাড়াও টক দই এর সাথে নিম পাতা বেটে মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে রাখতে হবে। আমরা সবাই জানি নিম পাতা ব্রণ দূর করার জন্য কতটা কাযর্করি। ব্রণ দূর করতে এই টক দই ও নিম পাতার ফেইস প্যাক টি দারুণ কাজ করবে।
স্ক্রাবিং করার জন্য টক দই
আমরা অনেকেই স্ক্রাবিং করি আবার অনেকেই করি না। কিন্তু আসলে আমাদের একটি সুস্থ ত্বক পেতে হলে অবশ্যই স্ক্রাবিং করা দরকার। অন্তত সপ্তাহে ১-২ দিন স্ক্রাবিং করা জরুরি কারণ আমাদের ত্বকের উপরে যেই মৃত কোষ থাকে সেটাকে পরিষ্কার করে নেয়া খুব দরকার।
না হলে ত্বক খুব ডাল লাগে। আর এই মৃত কোষ পরিষ্কার করার একমাত্র উপায় হলো স্ক্রাবিং।
এক্ষেত্রে আমরা দুই চামচ টক দই এর সাথে নিতে পারি ২ চামচ চালের গুঁড়া। চালের গুঁড়া স্ক্রাবিং এর জন্য খুব উপকারি একটি উপাদান। উপাদান দুটি ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে circular motion এ মুখে খুবই আলতো ভাবে মালিশ করতে হবে।
কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে মুখে কখনও জোরে ঘষা যাবে না। খুব আলতো হাতে ঘষতে হবে। ফলে আমাদের ত্বক থেকে মৃত কোষ উঠে যাবে। ত্বক অনেক উজ্জ্বল দেখাবে।
আরো পড়ুনঃ বডি স্ক্রাব ব্যবহারের নিয়ম
কালো দাগ দূর করতে টক দই
টক দই এর সাথে কয়েক ফোটা লেবুর রস মিশিয়ে মুখে নিয়মিত লাগালে মুখ থেকে ব্রণের দাগ অনেকটাই দূর হয়ে যায়।
অনেকের আবার লেবু suit করে না। লেবু মুখে দিলে জলে বা চুলকায়। সেক্ষেত্রে পরিমাণ মতো টক দই এর সাথে নিতে হবে আলুর রস। আলু প্রাকৃতিক ভাবে ব্লিচিং এর কাজ করে। এবং মুখ এর কালো দাগ দূর করার জন্য এই প্যাক টি খুব ই কার্যকরী।
টক দই এর ফেসিয়াল করার নিয়ম এবং উপকারিতা
একটি সুস্থ ত্বক পেতে হলে ফেসিয়াল করা অবশ্যই খুব দরকার। আমাদের ত্বকে প্রতিনিয়ত ময়লা জমতে থাকে, এছাড়াও ত্বকের উপরে মৃত কোষ জমা হতে থাকে যার কারণে আমাদের স্কিন প্রাণহীন হয়ে পড়ে, দেখতে ডাল লাগে।
এই সকল সমস্যা এক সাথে নিরাময় করে একটি সুস্থ ও উজ্জ্বল ত্বক পাওয়ার দরকার একটি উপযুক্ত ফেসিয়ালের। কিন্তু ফেসিলেয়ার নাম শুনলেই আমাদের মাথায় প্রথমেই আসে পার্লার এর কথা। যাতে লাগে অনেক সময় এবং টাকা। আসলে বাড়িতে বসেই খুব সহজেই একটি পারফেক্ট ফেসিয়াল করা যায়। এর জন্য দরকার কয়েকটি সঠিক উপাদান এর।
আজ আমরা জানবো বাড়িতে বসেই কিভাবে টক দই এর সাহায্যে ফেসিয়াল করে নিতে পারেন এবং এর উপকারীতা গুলো কি কি~
ফেসিয়াল এর তিনটি ধাপ রয়েছে। ক্লিনজিং, স্ক্রাবিং এবং ফেইস প্যাক।
প্রথমেই আমরা এমন একটি ক্লিনজার তৈরি করবো যা একইসাথে ক্লিনজিং এবং স্ক্রাবিং এর কাজ করবে। তার জন্য আমাদের সবার প্রথমে প্রয়োজন হবে এক চামচ টক দই, এক সাথে মেশাতে হবে এক চামচ বেসন। দুটি উপাদানকে ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে মুখে লাগাতে হবে।
এরপর হাত দিয়ে আলতোভাবে ঘষতে হবে। এক্ষেত্রে নিচ থেকে উপর দিকে circular motion এ ঘষতে হবে। একদমই জোরে ঘষা যাবে না। এই ভাবে ঘষে নিতে হবে ২ মিনিট। এরপর অপেক্ষা করতে হবে ৩-৪ মিনিট। ৪ মিনিট পরে নরমাল পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
এরপর করতে হবে ফেইস মাসাজ। বানিয়ে নিতে হবে একটি মাসাজ ক্রিম। এই ক্রিম বানানোর জন্য লাগবে এক চামচ টক দই। মাসাজ এর জন্য এই এক চামচ টক দই ই যথেষ্ট। বাজারের যেকোনো মাসাজ ক্রিম এর চাইতে এই টক দই ভালো কাজ করে।
টক দই মুখে লাগিয়ে হাতের আঙুল এর সাহায্যে আলতো ভাবে মাসাজ করে নিতে হবে। এভাবে মাসাজ করতে হবে ৫ মিনিট। এরপর নরমাল পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ত্বক অনেক নরম হয়।
এবার তৃতীয় ধাপে আমরা তৈরি করবো ফেইস প্যাক। এই প্যাক তৈরি করতে আমাদের আবার লাগবে টক দই। এক চামচ টক দই এর সাথে নিতে হবে কমলার খোসার পাউডার। এই পাউডার টি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে যে কত টা কাজ করে তা বলে বোঝানো যাবে না। উপাদান দুটি ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে মুখে লাগিয়ে ১৫-২০ মিনিট রেখে নরমাল পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
সপ্তাহে যদি ১-২ বার এই ফেসিয়াল টি করতে পারেন তাহলে ত্বকের যাবতীয় সমস্যা যেমন – Acne, Blemishes, pigmentation ইত্যাদি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এবং আমরা পেতে পারি একটি healthy, smooth skin.
আরো পড়ুনঃ টক দই দিয়ে ফর্সা ও উজ্জ্বল ত্বক পেতে ৫টি ফেসপ্যাক, এলোভেরা দিয়ে ফর্সা হওয়ার উপায়, এলোভেরা দিয়ে মুখের যত্ন নেয়ার নিয়ম
সাবধানতাঃ ত্বকে লাগানোর জন্য বাড়িতে তৈরি করা টক দই ই সবচেয়ে নিরাপদ। তবে মাথায় রাখতে হবে সেই টক দই এ যেন কোনো রকম চিনি ব্যবহার করা না হয়। মিষ্টির দোকানে যেই টক দই বিক্রি করে তা রুপচর্চার টক দই হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
কারণ সেই টক দই গুলোতে ডালডা এবং তেল জাতীয় কিছু মেশানো থাকে যা ত্বকের জন্য ভালো না। উল্টো ওই টক দই ব্যবহার করলে মুখে পিম্পল বা র্যাশ হতে পারে। এছাড়াও যদি কারও টক দই এ এলার্জি থাকে তাহলে তা মুখে দেয়া যাবে না। কিভাবে বাড়িতে টক দই তৈরি করবেন সে সম্পর্কে একটি পোস্টে বিস্তারিত গাইডালাইন দিয়েছি। তাই টক দই রেসিপি পোষ্ট থেকে জেনে নিন।
উপরের উপাদান গুলো ছাড়াও টক দই শশার রস, টমেটোর রস, মসুরের ডাল, ময়দা ইত্যাদি উপকারী উপাদান এর সাথে মিশিয়েও দেয়া যাবে। তবে তা নির্ভর করছে আপনার ত্বকের ধরণ কি তার উপর। নিজের ত্বকের ধরণ বুঝে সঠিক উপাদান মিশিয়ে টক দই এর সাথে ব্যবহার করলে স্কিন এর সকল সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে।