গর্ভাবস্থায় মধু খাওয়ার উপকারিতা অনেক। সেই সাথে অতিরিক্ত খাওয়ার কিছু অপকারিতা ও আছে। এই পোস্টে আপনারা জানতে পারবেন, গর্ভাবস্থায় মধু খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা এবং নিয়ম সম্পর্কে।
গর্ভাবস্থা এমন একটি সময় যখন একটি মা শুধু তার নিজের একার নয় বরং তার মধ্যে ক্রমাগত বাড়তে থাকা একটি ছোট্ট শিশুর পরিচর্চার দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। এসময় তার শারীরিক মানসিক অবস্থার খেয়াল রাখতে এবং শরীরকে সার্বক্ষণিক এনার্জি প্রদান করতে একটি সুষম খাদ্য তালিকার জুড়ি নেই। সেই খাদ্য তালিকায় শাক সবজি ফলমূল আমিষ এর পাশাপাশি শুকনো খাবার এবং কিছু তরল পানীয় যোগ করে নিলে তা একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ খাদ্য তালিকায় পরিনত হয়। আজকে আমরা আমাদের এই পোস্টের মাধ্যমে অর্গানিক এমন একটি খাদ্যের উপকারিতা তুলে ধরবো যেটি অসংখ্য খনিজ উপাদান ও মিনারেলস দিয়ে পরিপূর্ণ। সেই খাদ্য উপাদান টি হলো মধু।
মধু এমন একটি প্রাকৃতিক হারবাল উপাদান যার গুনাগুন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান প্রায় কয়েক হাজার যুগ পুরনো। এটি বেশিরভাগ সময়ই চিনির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। এবং এটি খেতেও অনেক সুস্বাদু। এতে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান রয়েছে ভিটামিন খনিজ পদার্থ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সহ বিভিন্ন ধরনের অ্যামাইনো এসিড। তাই গর্ভবতী মহিলাদের জন্য এটি অত্যন্ত উপকারী বলে মনে করা হয়।
আরো পড়ুনঃ গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ, গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা, নরমাল ডেলিভারি হওয়ার উপায় এবং করণীয়
গর্ভাবস্থায় মধু খাওয়ার উপকারিতা
ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করতে সাহায্য করে
মধুর এন্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য থাকার ফলে এটি গর্ভবতী মা ও শিশুর ঠান্ডা এবং ফ্লু খুব অল্পসময়ের মধ্যেই নিরাময় হয়। এসময় মায়ের ঠান্ডা গর্ভের সন্তান এর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই এসময় গর্ভবতী মহিলার যাতে ফ্লু না হয় তার জন্য বিভিন্ন ধরনের মধু খেতে পারেন। সকালে হালকা গরম পানির সাথে মধু মিশিয়ে পান করতে পারেন।
গলা ব্যাথা এবং কাশির দ্রুত নিরাময় করে
প্রচণ্ড ঠান্ডায় বা শীতকালে অনেকেরই অনবরত কাশি বা ঠান্ডা জনিত সমস্যা লেগেই থাকে। গলায় প্রচন্ড ব্যথা হয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই শরীরের তাপমাত্রা অনেক কমে যায়। এমতাবস্থায় যদি আপনি মধু খেতে পারেন তাহলে আপনার শরীর ভেতর থেকে গরম থাকবে এবং গলা ব্যথা এবং ঠান্ডার উপশম অনেকটাই প্রশমিত করবে।
শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে ভালো রাখে
যেকোনো গর্ভবতী নারীর শরীরে একটি শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম থাকা অতি জরুরি কারণ এসময় মা এবং শিশুকে নানা জটিলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এমতাবস্থায় নিয়মিত মধু খেলে শরীরের মেটাবলিক রেইট বাড়ে এবং একটি শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম বিল্ড আপ হয়। মধুতে বিদ্যমান এর পুষ্টিগুণ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমূহের উপস্থিতির কারণেই এটি ইমিউনিটি সিস্টেম বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম।
গ্যাসট্রিক এবং আলসার প্রতিরোধ করে
গ্যাসট্রিক গর্ভাবস্থায় একটি কমন ব্যধি। তখন বেশিরভাগ ডাক্তাররা নিয়মিত গ্যাসট্রিক এর ঔষধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এসময় যাদের ইতোমধ্যেই আলসার হয়ে গেছে বা প্রচন্ডরকম গ্যাস এর সমস্যা হচ্ছে তারা নিয়মিত মধু সেবনে উপকার পেতে পারেন।
অনিদ্রা জনিত সমস্যা দূর করে
গর্ভাবস্থায় বেশিরভাগ নারীরই শেষ তিনমাস অনিদ্রার সমস্যা প্রকট হয়। এই সমস্যা নানা কারণে হতে পারে। যদি আপনার ব্লাড সুগার পরিমিত পরিমানে থাকে তাহলে এসময় আপনি রাতে ঘুমানোর আগে এক চা চামচ মধু খেয়ে নিতে পারেন। বা হালকা কুসুম দুধের সাথে মিশিয়ে ও খেতে পারেন। এতে আপনার দ্রুতই ঘুম চলে আসবে।
এলার্জি দূর করে
যেহেতু মধুতে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং anti-inflammatory প্রপার্টিজ রয়েছে, সেহেতু নিয়মিত মধু সেবনে শরীরের অ্যালার্জির সমস্যা বা চর্ম জাতীয় যেকোনো সমস্যা থেকে অনেকটাই রেহাই পাওয়া যায়। গর্ভাবস্থায় যখন শিশু আকারে বাড়তে শুরু করে তখন শরীরের নানা অংশের চামড়ায় বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা দেয়। এবং চামড়া ফাটা শুরু হয়।তখন সেসব স্থানে অ্যালার্জির প্রকোপ দেখা দেয়। তাই এসময় আপনি যদি নিয়মিত মধু সেবন করেন অ্যালার্জির প্রকোপ থেকেও আপনি নিজেকে অনেকটা বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন।
মাথার স্ক্যাল্প ও শরীরের ত্বক উন্নত হয়
আমরা সবাই জানি মধু ত্বকের যত্নে বা শরীরের নানা অঙ্গ পতঙ্গের সৌন্দর্য বর্ধনে কতটা কার্যকরী। গর্ভাবস্থায় কারো কারো এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে মায়ের ত্বকে অনেক ব্রণ দেখা দেয়,ত্বক ফেটে যায় এবং ত্বকের বিভিন্ন অংশে কালো ছোপ ছোপ দাগ পড়ে। কখনো কখনো পুরো নয় মাস এই অবস্থার মধ্য দিয়ে নারীদের যেতে হয়। ত্বকে নানা পরিবর্তন ঘটে থাকে হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে।
তাই এই নিয়ে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। গর্ভাবস্থার পরবর্তী সময়ে এসব সমস্যার সহজ সমাধান করা সম্ভব। তাই দীর্ঘ নয় মাস আপনি যদি নিয়মিত পরিমাণে মধু ব্যবহার করতে পারেন আপনার ত্বক এবং মাথার স্ক্যাল্প বা চুলের ত্বকেও একটি অভূতপূর্ব ফলাফল পাওয়া যায়। এবং আপনার ত্বক এই পুরোটা সময় জুড়ে অনেক সুন্দর ও উজ্জ্বল থাকে।
আরো পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় নিম্ন রক্তচাপ, কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিরোধের উপায়, গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ওজন বৃদ্ধির উপায়, ওজন না বাড়ার কারণ
গর্ভাবস্থায় মধু খাওয়ার নিয়ম
গর্ভবতী মহিলাদের কতটা মধু খাওয়া উচিত এটি একটি কমন প্রশ্ন। যেহেতু গর্ভাবস্থায় খাবার খেতে কিছু কিছু সতর্কতা, শারীরিক অবস্থা বুঝে নিতে হয় তাই সেসময় প্রতিদিন কত চামচ করে মধু ব্যবহার করলে আপনার শারীরিক কোনো অসুবিধা হচ্ছেনা তা আগেই যাচাই করে নিবেন।
যাদের ডায়বেটিস নেই, তারা প্রতিদিন তিন থেকে পাঁচ চামচ পর্যন্ত মধু সেবন করতে পারেন।প্রয়োজনবোধে যদি নিয়মিত মধু খেতে হয় তাহকে ১-৩ চামচ খাওয়া উচিত।
মধুতে রয়েছে ফ্রুটোজ গ্লুকোজ এবং মল্টোজ এর গুনাগুন। ১ টেবিল চামচ থেকে প্রায় ৬০ ক্যালোরি শক্তি শরীরে প্রবেশ করে।
দিনে খালি পেটে বা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মধু সেবন করলে বেশি উপকার লাভ করা সম্ভব।
গর্ভাবস্থায় মধু সেবনের কিছু সতর্কতা
১. গর্ভাবস্থায় মধু খাওয়া অনেক উপকারী হলেও এ সময় দূষিত মধু খাওয়ার ফলে একটি বিরল রোগ হয়ে থাকে যার নাম ‘বোটুলিজম’। এতে থাকে ক্লোস্ট্রিডিয়া স্পোর নামে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া। যদিও এই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হবার ঘটনা অনেক কম, তারপরও মধু সেবন এই বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। আর একটি বিষয় বলে রাখা ভালো এই ব্যাকটেরিয়া গর্ভবতী নারীর ভ্রুণকে প্রভাবিত করতে পারেনা কারণ প্লাসেন্টার নিকটবর্তী হলেই সেই ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয়ে যায়।
২. পরিমিত পরিমানে মধু সেবন করবেন। দিনে ১-৩ চামচ এর বেশি নয়।
৩. ডায়বেটিস থাকলে অবশ্যই ডাক্তার এর পরামর্শ নিয়ে নিবেন।
৪. প্রচন্ড গরমে মধু খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন।
৫. দিনে ঘুম থেকে উঠে বা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মধু সেবন করতে পারেন। দুপুরে মধু সেবন করবেন না।
৬. দুধ চা বা পানির সাথে মধু মিশিয়ে খেতে হলে হালকা কুসুম গরম দেখে মধু যোগ করবেন নাহয় তা বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে।
৭. মধু কাচের জারে সংরক্ষণ করবেন। প্লাস্টিক এর কোনো কৌটা ব্যবহার থেকে বিরত থাকবেন।
গর্ভাবস্থায় মধু খাওয়ার অপকারিতা
যদিও মধুর তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই এবং যে কোন অবস্থাতে মধু খাওয়া অনেকটাই নিরাপদ। কিন্তু তারপরও কিছু মহিলার গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস দেখা দেয় এবং তাদের রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই সে সময় অত্যাধিক কার্বোহাইড্রেট ও চিনি জাতীয় খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকা উচিত।
অনেকের কাছেই মধু অনেক সুস্বাদু একটি খাবার হওয়ায় তারা প্রয়োজন এর বেশি পরিমাণে তা সেবন করে ফেলেন। যার ফলে প্রচন্ড পেট ব্যথা হতে পারে। তার সাথে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল, ডায়রিয়া ইত্যাদিও হতে পারে। এবং এর যেকোনো একটিই গর্ভের বাচ্চার জন্য হুকমি হতে পারে।
গ্রীষ্মেকালে মধু কম খাওয়া উচিত কারন মধু আপনার শরীরকে ভেতর থেকে গরম করে দিচ্ছে। তাই গর্ভের ভ্রূণ এর জন্য তা অনেকটাই খারাপ হতে পারে।গর্ভাবস্থায় শরীরে তাপমাত্রার ভারসাম্য থাকাটা অনেক বেশি জরুরি। এ কারণে যদি নিয়মিত মধু খেতে চান তাহলে শীতকালেই শুধুমাত্র নিয়মিত মধু সেবন করবেন এবং অবশ্যই তা পরিমিত পরিমাণে।
আরো পড়ুনঃ