ডেঙ্গু জ্বর হলে সঠিক সময়ে বুঝতে না পারলে এবং সঠিক চিকিৎসা না নিলে মৃত্যু হতে পারে। তাই, ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ গুলো সম্পর্কে আমাদের সবার ধারণা থাকা উচিত। এখন বাংলাদেশের প্রায় সকল এলাকায় ডেঙ্গু মশার উপদ্রব অনেক বেড়ে গিয়েছে। এর ফলে অনেকেই ডেঙ্গু মশার কামড় খেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। আপনি যদি ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে না জেনে থাকেন, তবে এই পোস্টটি সম্পূর্ণ পড়ুন। পোস্টটি সম্পূর্ণ পড়লে, ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ, ডেঙ্গু জ্বর হলে কি মানুষ মারা যায়, ডেঙ্গু রোগের কারণ কি এবং ডেঙ্গু জ্বর হলে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
ডেঙ্গু জ্বর কী?
এডিস মশার কামড়ের কারণে ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকে। কয়েক প্রজাতির এডিস মশকী (স্ত্রী মশা) ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। এগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি মশকী প্রধান। আপনার বাসার আশেপাশে যদি কোনো জলাশয় থাকে, তবে সেখানে এডিস মশার জন্ম হতে পারে। এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে। এডিস নামে মশাগুলো অন্যান্য সকল মশার থেকে বড় ও গায়ে ডোরাকাটা দাগ থাকে। এসব মশা বৃষ্টি-পরবর্তী সময়ে জলাবদ্ধ এলাকায় বংশবিস্তার করে থাকে। এছাড়াও, ঘরে থাকা টব বা ফুলদানির পানিতেও এডিস মশা বংশবিস্তার করে থাকে। এই মশার কামড়ে আপনার ডেঙ্গু জ্বর হতে পারে। এডিস মশা কামড় দিলে ৩ থেকে ১৫ দিনের মাঝে ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ দেখা যায়। ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো হচ্ছে –
- জ্বর
- মাথাব্যথা
- বমি
- পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা
- গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি
উপরে উল্লিখিত উপসর্গগুলোর সবগুলো কিংবা যেকোনো কয়েকটি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এই উপসর্গগুলোর যেকোনো একটি বা একের অধিক দেখা দিলে আপনাকে বুঝে নিতে হবে যে আপনি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। ডেঙ্গুকে রক্তক্ষরী জ্বর (ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার) বলা হয়ে থাকে। ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার কারণে, রক্তপাত হয়, রক্ত অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্ত প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে। আবার কখনো কখনো ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম দেখা যায়। এ পরিস্থিতিতে শরীরের রক্ত অনেক বিপদজনকভাবে কমে যায়। এর ফলে একজন মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ
সারাদেশের অনেক জায়গায় জলাশয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে এসব জলাশয় এ বিভিন্ন জাতের মশা জন্মগ্রহন করছে। এসব মশার মাঝে ডেঙ্গু রোগ ছড়ানো এডিস মশাও রয়েছে। যেসব জায়গায় অধিক জলাশয় রয়েছে এবং অনেকদিন যাবত পানি নিষ্কাশন করা হয়নি, সেসব জায়গায় এই মশাগুলো বংশবিস্তার করছে। ফলে দিন দিন আমাদের দেশে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এছাড়াও, ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হওয়া মানুষের পরিমাণে নেহাতই কম না। এজন্য আমাদের সবার ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ সমন্ধে জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
নিম্নে আমি সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরের কিছু লক্ষণ উল্লেখ করে দিলাম, এগুলো দেখা দিলে আপনাকে বুঝে নিতে হবে যে ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে। এরপর ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া অতিব জরুরী।
ডেঙ্গু ক্লাসিক্যাল জ্বরসমূহ :
- সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরে তীব্র জ্বর এবং সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়ে থাকে।
- জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে।
- তীব্র পেট ব্যাথা।
- হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি এবং মাংসপেশীতে তীব্র ব্যথা।
- মাথা এবং চোখের পিছনে ব্যাথা।
- বমি বমি ভাব কিংবা বমিও হতে পারে।
- খাবারের রুচি কমে যাওয়া, ক্লান্তি ক্লান্তি ভাব।
উপরে উল্লিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে বুঝতে হবে যে রোগী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। আপনি কিংবা আপনার আশেপাশের কারো যদি এসব লক্ষণ দেখা যায়, তবে যতদ্রুত সম্ভব ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন। উপরে উল্লিখিত লক্ষ্যণগুলো ছাড়াও ডেঙ্গু জ্বরের আরও কিছু লক্ষণ রয়েছে।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরসমূহ :
সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার পর যখন রোগীর অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে যায়, তখন সেই অবস্থাকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর বলা হয়ে থাকে। এ অবস্থায় রোগীর মাঝে ডেঙ্গু ক্লাসিক্যাল সিন্ড্রোম ছাড়াও আরও কিছু উপসর্গ দেখা যায়। এগুলো হচ্ছে –
- শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। নাক ও মুখ দিয়ে, মাড়ি ও দাঁত হতে, চামড়ার নিচে, রক্তবমি, কফের সঙ্গে, পায়খানার সাথে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে এবং চোখের বাহিরে থেকে রক্ত পড়া। নারীদের ক্ষেত্রে অসময়ে ঋতুস্রাব শুরু হলে দীর্ঘসময় যাবত রক্ত পড়তে থাকে।
- ডেঙ্গু জ্বরের হেমোরেজিক অবস্থায় বুক বা পেটে পানি জমতে পারে। অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস হয়। কিংবা কিডনিতে ডেঙ্গু জ্বর আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলোর মাঝে হেমোরেজিক অবস্থায় রোগীর মাঝে অনেক খারাপ লক্ষণ দেখা যায়। রোগীর অবস্থার অনেক অবনতি হয়ে যায়। লক্ষণ দেখা দিলে যতদ্রুত সম্ভব ডাক্তারের কাছে কিংবা স্থানীয় হাস্পাতালে নিয়ে যেতে হবে। প্রতিবছর আমাদের দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করছে।
ডেঙ্গু শক সিনড্রোমগুলো :
ডেঙ্গু জ্বর ভয়ানক রূপ ধারন করলে নিম্নে উল্লিখিত ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো দেখা যায়। ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের সঙ্গে সার্কুলেটরি ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়।
- হঠাৎ রক্তচাপ কমে যাওয়া।
- নাড়ীর স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ এবং দ্রুত হয়।
- হাত পা এবং শরীরের অন্যান্য অংশ ঠান্ডা হয়ে যায়।
- প্রসাব এর পরিমাণ কমে যাওয়া।
- হঠাৎ করে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ডেঙ্গু হলে জ্বর আসবে এটা নিশ্চিত। এজন্যই এই রোগের নাম ডেঙ্গু জ্বর রাখা হয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ গুলো উপরে উল্লেখ করে দিয়েছি। আশা করছি উপরে উল্লিখিত লক্ষণগুলো সঠিকভাবে পড়ে নিলে পরবর্তীতে ডেঙ্গু জ্বর হলে বুঝতে পারবেন যে আসলে ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে নাকি সাধারণ জ্বর।
ডেঙ্গু জ্বর হলে করণীয়
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ দেখা দিলে, তবে আপনার প্রথমেই করণীয় হচ্ছে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া। উপরে ইতোমধ্যে আমি ডেঙ্গু জ্বরের সবগুলো লক্ষণ উল্লেখ করে দিয়েছি, এসব লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের কাছে কিংবা নিকটস্থ হাসপাতালে রোগিকে নিয়ে যাবেন। ডেঙ্গু জ্বরকে সাধারণভাবে নিবেন না। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে অনেকেরই মৃত্যু হচ্ছে। হাঁপানি, সিওপিডি বা আইএলডি-র মতো ফুসফুসের রোগ থাকলে বাড়তি ব্যবস্থা নিতে হবে। নয়তো, রোগীর অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে যেতে পারে। ডেঙ্গু জ্বর হলে সাধারণ জ্বর ভেবে ওষুধ খেয়ে জ্বর কমার জন্য অপেক্ষা করলে সেটি আরও ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। তাই, ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ এবং ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে এরপর সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকে যে, ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ দেখা দিলে কখন ডাক্তার দেখাবো বা কখন হাসপাতালে নিয়ে যাবো। যেকোনো রোগ এর ক্ষেত্রে, শুরুর দিকে যদি ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া হয় তাহলে অনেক দ্রুত এবং সহজেই সেই রোগ থেকে নিস্তার পাওয়া যায়। কিন্তু, যখন সেই রোগ আমাদের শরীরে অনেক ভালো ভাবে বাসা বাধে, তখন সমস্যা দেখা যায়। তাই, ডেঙ্গু জ্বরের যেসব লক্ষণ এর কথা উপরে উল্লেখ করে দিয়েছি, সেগুলো যদি রোগীর মাঝে দেখা যায়, তবে যতদ্রুত সম্ভব ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন। আর্থিক সমস্যা থাকলে আলাদা করে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে গিয়ে সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। তবে, ডেঙ্গু জ্বরের কিছু উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এগুলো হচ্ছে –
- প্রচণ্ড পেটে ব্যথা বা বমি হলে।
- জন্ডিস দেখা দিলে।
- শরীরের যে কোনো অংশ থেকে রক্তপাত হলে।
- প্লাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে।
- প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে।
- অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা দেখা দিলে।
- শ্বাসকষ্ট হলে বা পেট ফুলে পানি আসলে।
ডেঙ্গু জ্বরকে মরণব্যাধি বলা হয়ে থাকে। সঠিক সময়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। পোস্টে উল্লিখিত সকল লক্ষণ এবং উপসর্গ যদি কারো মাঝে দেখা যায়, তবে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন।
আরো পড়ুন: ডেঙ্গু জ্বর হলে কি গোসল করা যাবে
আরো পড়ুন: দই খাওয়ার উপকারিতা এবং অপকারিতা