গর্ভাবস্থায় নারীদের খাদ্যাভাসে অনেক পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়। এসময় উচ্চ পুষ্টি সম্পন্ন খাবার খাওয়ার এবং বাহিরের খাবার বর্জন করতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞ এবং ডাক্তাররা। এসব বিষয়ে গর্ভাবস্থায় নারীদের খুব সচেতন থাকতে হয়। জীবনধারণ ও খাদ্যের ব্যাপারে সচেতন হলেই এই অবস্থায় অনেক ঝুঁকি এড়িয়ে একটি সুস্থ স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করতে পারেন মায়েরা। তাই এ সময় নিয়মিত পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার বা সুষম খাবার খাওয়া উচিত।
গর্ভবতী মায়েদের খাদ্য তালিকায় ফল শাকসবজির সাথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী যে খাবার গুলো গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয় এর মধ্যে একটি হলো ড্রাই ফ্রুটস খাওয়া। শুকনো ফল, বাদাম, এপ্রিকট, ডুমুর আপেল, আখরোট, কিসমিস, কাজুবাদাম কিংবা পেস্তা বাদাম। এসব খাবার গর্ভবতী মায়েদের গর্ভের সন্তান এর বৃদ্ধিতে দারুন কাজ করে থাকে। এসব স্বাস্থ্যকর খাবারে বিদ্যমান থাকে হাই প্রোটিন, ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন ইত্যাদি।
আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় হলো এমনই একটি ড্রাই ফ্রুটস নিয়ে। এটি হলো খেজুর। এই পোস্টটিতে আমরা জানবো গর্ভাবস্থায় খেজুর খাওয়ার উপকারিতা, এর কিছু অপকারিতা, কখন খাওয়া উচিত সেসব সম্পর্কে।
খেজুরের পুষ্টিগুন
খেজুর একটি উচ্চ প্রোটিন ও ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার। এর মধ্যে রয়েছে ফোলেট, অন্যান্য খনিজ উপাদান যেমন পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন ইত্যাদি। পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার থাকার কারণে এই খেজুর অনেকক্ষণ পেটে থাকে এবং ডায়েট ফুড হিসেবে ও অনেকে গ্রহণ করে থাকেন।
গর্ভাবস্থায় খেজুর খাওয়ার উপকারিতা
আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি খেজুরের রয়েছে অনেক পুষ্টি গুন। এই ফলের গুনাগুন আর উপকারিতা বলে শেষ করা যাবেনা।
গর্ভাবস্থায় খেজুর খেলে কি কি উপকার হয় তা নিচে দেয়া হলো।
গর্ভের বাচ্চার ওজন বৃদ্ধিতে কার্যকর
অনেক গর্ভবতী মহিলাদের বাচ্চার ওজন সহজে বাড়তে চায়না। সেই জন্য মায়েরা নানা দুশ্চিন্তায় ভোগেন। এমনকি অনেকের প্রচুর পরিমাণে বমি হওয়ার কারণে বাচ্চার গ্রোথ বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বৃদ্ধি ভালো হয় না। তাই গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই নিয়মিত খেজুর খেলে আপনার গর্ভের বাচ্চার ওজন বৃদ্ধির পাশাপাশি শারীরিক নানা বৃদ্ধি ও ত্বরান্বিত হবে।
আরো পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ওজন বৃদ্ধির উপায়, ওজন না বাড়ার কারণ, গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ওজন চার্ট ওবং ওজন বৃদ্ধি
গর্ভের বাচ্চার হাড় ও শারীরিক বৃদ্ধিতে কার্যকরী
ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম গর্ভের বাচ্চা হাড় ও দাঁত গঠনে ভূমিকা পালন করে। খেজুরে বিদ্যমান ম্যাগনেসিয়াম এবং অ্যামিনো অ্যাসিড শুধুমাত্র গর্ভের বাচ্চার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নয় বরং এর শারীরিক বৃদ্ধিতে খেজুর দারুণ কার্যকর।
শক্তির যোগান দেয়
গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর খাবার এবং শক্তির যোগান দিতে হয় মাকে। আর আমরা জানি খেজুর হাই প্রোটিন ও ফাইবার সমৃদ্ধ একটি খাবার। এর খনিজ উপাদান গুলো থেকে প্রচুর শক্তির সঞ্চার হয় গর্ভবতী মায়ের শরীরে। প্রতি ১০০ গ্রাম আয়রনে রয়েছে ২৭৭ কিলোক্যালরি শক্তি, ১.৮ গ্রাম প্রোটিন এবং ৬.৭ গ্রাম ফাইবার। যেহেতু স্বাভাবিকের তুলনায় গর্ভবতী মায়েদের শরীরে বেশি শক্তির প্রয়োজন, তাই এসময় খেজুর খেয়ে খুব সহজেই গর্ভবতী মায়েরা শক্তির যোগান দিতে পারেন।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য অনেক কমন একটি সমস্যা। এই সমস্যা ফেইস করেন নি এমন গর্ভবতী নারীর সংখ্যা অনেক কম। প্রোজেস্টেরন হরমোন এর কারণে এসময় শরীরে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। খেজুরের রসে রয়েছে ফাইবার যা হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
জন্মগত সমস্যা বা ত্রুটি এড়াতে সাহায্য করে
জন্মগত সমস্যা যেমন বোবা, বাকপ্রতিবন্ধী রোধে যে কোন ডাক্তার গর্ভবতী মায়েদের একটা কমন মেডিসিন খেতে বলেন সেটি হলো ফলিক এসিড বা ফোলেট ট্যাবলেট। এই ট্যাবলেট গর্ভের বাচ্চার নানা ত্রুটি এড়াতে সাহায্য করে। এরকমই একটি প্রাকৃতিক উপাদান হলো খেজুর যাতে প্রচুর পরিমাণে ফোলেট বিদ্যমান। তাই গর্ভের বাচ্চার জন্মগত ত্রুটি এড়াতে এক অদ্বিতীয় ভূমিকা পালন করে থাকে এই খেজুর।তাই এই ট্যাবলেট এর পাশাপাশি প্রতিটি গর্ভবতী মায়েরই খেজুর খাওয়া উচিত।
শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে
খেজুরে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম থাকার কারণে এটি আমাদের শরীরের রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণ রাখে। শরীরের পেশী গুলিক সচল না থাকলে তা রক্তচাপ বাড়িয়ে তোলে এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। খেজুরের মধ্যে বিদ্যমান পটাশিয়াম এই সমস্যাগুলি নিরসনে সাহায্য করে এবং শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে। গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে গর্ভের সন্তান এর মারাত্মক ক্ষতি এবং জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে। এমনকি গর্ভপাত হওয়ার আশংকা ও বেড়ে যায়।তাই এসময় খেজুর খাওয়া অনেক জরুরি।
আরো পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় নিম্ন রক্তচাপ, কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিরোধের উপায়, গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা, মাস অনুযায়ী ডায়েট প্ল্যান
শিশুর শরীরে ‘ভিটামিন-কে’ এর যোগান দেয়
শিশুরা জন্মগত ভাবেই ভিটামিন-কে কম নিয়ে জন্ম নেয়। এবং জন্মের পরপর সেই ভিটামিন এর ঘাটতি পূরণ ও সম্ভব হয়না। তাই শিশু গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন মা যদি খেজুর নিয়মিত খান তাহলে গর্ভের বাচ্চা এই ভিটামিন এর যোগান হয়ে যায়।
খেজুর খাওয়ার কিছু অপকারিতা
খেজুর খাওয়ার হাজারো গুনাগুন রয়েছে। কিন্তু অত্যাধিক সবকিছুই খারাপ তাই অধিক পরিমানে খেজুর খেলে এর কিছু ক্ষতিকর প্রভাব ও দেখা দেয়।
১. খেজুরে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিগুণ রয়েছে। আপনি যদি খেজুর অনেক বেশি পছন্দ করেন বলে প্রচুর পরিমাণে তা খেতে শুরু করেন, এবং পাশাপাশি কার্বোহাইড্রেট বা অন্যান্য খাবার ও যদি অধিক পরিমানে খান দুটি মিলিয়ে আপনার শরীর মুটিয়ে যেতে পারে।
২. ওজন বেড়ে যেতে পারে- যাদের ডায়াবেটিস আছে তারা সীমিত করে খেজুর খাবেন। অত্যাধিক খেলে ডায়াবেটিস বেড়ে যেতে পারে। যা এবং এটি গর্ভের বাচ্চার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
৩. রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়তে পারে।
গর্ভাবস্থায় খেজুর খাওয়ার কিছু সতর্কতা ও নিয়ম
১. উচ্চ রাসায়নিক সম্বৃদ্ধ খেজুর খাওয়া কখনোই উচিত নয়।
২. অনেক বেশি পছন্দ হলেও পরিমাণে বেশি খাওয়া উচিত নয়। প্রতিদিন মাঝারি সাইজের ২-৩ টির বেশি খেজুর খাবেন না।
৩. সারাদিনের যেকোনো সময় খেজুর খেতে পারেন। কিন্তু সকালে নাস্তা করার ২-৩ ঘন্টা পর ২ টি খেজুর খেয়ে নিতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় কোন কোন সময় খেজুর খাবেন?
গর্ভাবস্থায় খেজুর খাওয়ার তেমন কোনো ধরাবাধা সময় নেই। আপনি যেকোনো ট্রাইমেস্টার এ এটি গ্রহণ করতে পারেন কিন্তু অবশ্যই এর পরিমান টি মাথায় রেখেই খাবেন।
১. গর্ভাবস্থার প্রথম তিনমাস কোষ্ঠকাঠিন্য এর সমস্যা প্রকট থাকে।তাই তখন খেজুর খেলে গর্ভবতী নারী আরাম বোধ করবেন। কিন্তু কারো যদি আগে থেকেই ডায়বেটিস থাকে বা রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ না নিয়ে খেজুর খাওয়া উচিত হবে না।
২. অনেকেরই প্রথম ট্রাইমেস্টার এ গর্ভকালীন ডায়াবেটিস না থাকলেও এসময় এসে তা বেড়ে যায়।বা সাধারণত এসময় গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ঝুঁকি বেশি তাই এই সময়ে খেজুর খেতে হলে ডাক্তারের মতামত নেওয়া উচিত।
৩. ৩য় ট্রাইমেস্টার এ খেজুর খাওয়া অত্যন্ত উপকারী গর্ভবতী মায়েদের জন্য। অন্যান্য কোনো জটিলতা বা ডায়বেটিস না থাকলে এসময় প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ টি করে খেজুর খেতে পারেন। এতে ডেলিভেরি প্রক্রিয়া কিছুটা সহজ হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় যেকোনো খাবার বা ঔষধ সেবনে ডাক্তার এর পরামর্শ নিয়ে নিলেই এর উত্তম প্রতিদান পাওয়া সম্ভব। কিন্তু গর্ভাবস্থায় খেজুর খাওয়ার অনেক বেশি উপকারিতা রয়েছে তাই এসময় আপনার শারীরিক সুবিধা অসুবিধা বুঝে কিছুটা রিসার্চ করে, ডাক্তার এর সাথে পরামর্শ নিয়ে খেজুর গ্রহণ শুরু করবেন।
আরো পড়ুনঃ